অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত সম্প্রতি ভারতের নতুন এক অদৃশ্য অশুল্ক বাধার মুখে পড়েছে, যা বৈশ্বিক বাজারে সুযোগ কাজে লাগানোর পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রফতানিকারকরা জানিয়েছেন, গত কয়েক মাস ধরে দিল্লি, বেঙ্গালুরুসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর আঞ্চলিক অফিসে কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো পোশাকের নমুনা ভারতীয় কাস্টমস পরীক্ষার নামে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হচ্ছে, কখনোবা একেবারেই ছাড় করা হচ্ছে না। সাধারণত ৩–৫ দিনে পৌঁছানো স্যাম্পল এখন ১৫–২০ দিন পর্যন্ত বিলম্বিত হচ্ছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে একেবারেই আটকে দেওয়া হচ্ছে।

স্প্যারো গ্রুপের মতো রফতানিকারকরা বাধ্য হচ্ছেন স্যাম্পল বিমানে লোক মারফত পাঠাতে। কিন্তু এতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ২০ গুণ। আগে প্রতি ৫ কেজি ওজনের একটি স্যাম্পল প্যাকেট কুরিয়ারে পাঠাতে খরচ হতো প্রায় পাঁচ হাজার টাকা, এখন সেটি এক লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম এটিকে স্পষ্টতই একটি নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, “কুরিয়ার চালান ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত বা আটকে দেওয়া হচ্ছে। বাধ্য হয়ে এখন ফ্লাইটে হ্যান্ড ক্যারি করে পাঠাতে হচ্ছে, যা অস্বাভাবিক ব্যয়বহুল।”

শুধু স্প্যারো গ্রুপ নয়, ডিবিএল গ্রুপের এম এ জব্বার, ফকির ফ্যাশনস লিমিটেডের ফকির কামরুজ্জামান নাহিদসহ আরও অনেক রফতানিকারক জানিয়েছেন, ভারতের কাস্টমসের কারণে এখন স্যাম্পল পাঠাতে তিন থেকে চার গুণ বেশি সময় লাগছে। তাদের অভিযোগ—এটি একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ, যার লক্ষ্য বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকে ধীর করে দেওয়া।

এমন এক সময়ে এই বাধা তৈরি হলো, যখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক কাঠামো ভারতের তৈরি পোশাকের ওপর প্রায় ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, আর বাংলাদেশ থেকে আমদানিতে শুল্ক ২০ শতাংশ রাখা হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো ভারত থেকে অর্ডার কমিয়ে বাংলাদেশে সরিয়ে আনছে। কিন্তু ভারত এই পরিবর্তন ঠেকানোর জন্য অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে রফতানিকারকদের অভিযোগ।

ঢাকায় পুমার কান্ট্রি ম্যানেজার মঈন হায়দার চৌধুরীও একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “ভারতে আমাদের প্রায় ১,০০০ স্টোর আছে। নিয়মিত স্যাম্পল পাঠাতে হয়, কিন্তু এয়ার কুরিয়ারের শিপমেন্ট এখন প্রায় বন্ধ। ফলে বাধ্য হয়ে কিছু হ্যান্ড ক্যারি করতে হচ্ছে, যার কারণে ভেন্ডরদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।”

রফতানিকারকদের অভিযোগ, ভারত সরকার লিখিতভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা চালান আটকে দিচ্ছে। কুরিয়ার কোম্পানিগুলোরও একই অভিজ্ঞতা। ডিএইচএলের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে পাঠানো পোশাকের স্যাম্পল ভারতে গেলে প্রায়শই ছাড়পত্র পেতে সমস্যা হচ্ছে।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান বাবলু বলেছেন, “বায়ার ও রফতানিকারক উভয় পক্ষ থেকেই আমরা অভিযোগ পেয়েছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হবে।” তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক সুবিধার কারণে ভারত বাজার হারানোর আতঙ্কে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক টানাপোড়েনও পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সম্পর্ক শীতল হয়ে যায়। বাংলাদেশি পর্যটকদের ভিসা বন্ধ, বিভিন্ন পণ্যে বিধিনিষেধ আরোপ, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা স্থগিত করার মতো পদক্ষেপ নেয় ভারত। বাংলাদেশও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানি বন্ধ করে দেয়।

তবে এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশের রফতানি বেড়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় ভারতে রফতানি ১২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৬ কোটি ডলারে। এর প্রায় ৩৫ শতাংশ এসেছে পোশাক খাত থেকে। তবে খাদ্যপণ্য ও পাটজাত পণ্যের রফতানি হ্রাস পেয়েছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ জানিয়েছে, বিধিনিষেধের কারণে তাদের ভারতে রফতানি প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে এবং খরচ বেড়েছে ৮ শতাংশ।

রফতানিকারকরা আশঙ্কা করছেন, ভারতীয় কাস্টমসে কুরিয়ার আটকে দেওয়ার এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হুমকির মুখে পড়বে। কারণ সময়মতো স্যাম্পল অনুমোদন না হলে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো অর্ডার বাতিল করে অন্য দেশকে বেছে নিতে পারে।
অকা/তৈপোশি/ই/সকাল/১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 19 hours আগে

Leave A Reply

Exit mobile version