অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান হারাতে থাকা ভারতের বস্ত্রখাত এখন এক নতুন কৌশলগত মোড়ে দাঁড়িয়ে। ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয়, কঠোর নীতি-অনুবর্তিতা, এবং জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়ের চাপ—সব মিলিয়ে দেশটির টেক্সটাইল শিল্প ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মতো কম খরচের উৎপাদনভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে পিছিয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারত সরকার এক বিস্তৃত “ব্যয় রূপরেখা” (Cost Framework) তৈরি করছে, যার লক্ষ্য—বস্ত্রখাতকে বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং উৎপাদন ব্যয় কাঠামো পুনর্গঠন করে রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় তিনটি স্তর নির্ধারণ করা হয়েছে—দুই বছরের স্বল্পমেয়াদি, পাঁচ বছরের মধ্যমেয়াদি, এবং দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ। এতে কাঁচামালের সরবরাহ, কর কাঠামো, নীতি-অনুবর্তিতা, শ্রম ব্যয়, এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার দক্ষতা বিশ্লেষণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যয় বিশ্লেষণ মডেল তৈরি করা হবে।
সরকারি এক কর্মকর্তার ভাষায়, “লক্ষ্য হলো ভারতের ব্যয় কাঠামোকে বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করা, উৎপাদন ও রপ্তানি খরচ কমানো, এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অপচয় হ্রাসের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়ানো।”
বর্তমানে ভারতের বস্ত্র রপ্তানি প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, মূল্য প্রতিযোগিতায় ভারত পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও চীনের মতো দেশগুলোর কাছে।
বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি তুলনামূলকভাবে অনেক কম, যা তাদের উল্লেখযোগ্য খরচ-সুবিধা দিয়েছে। অন্যদিকে, ভিয়েতনামের শ্রম আইন অধিক নমনীয় এবং তাদের শ্রম উৎপাদনশীলতা ভারতের তুলনায় ২০–৪০ শতাংশ বেশি। এছাড়া, ইউরোপীয় বাজারে বাণিজ্য সুবিধা এবং চীনা বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার তাদের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা আরও শক্তিশালী করেছে।
এর বিপরীতে, ভারতের বস্ত্র খাত ভুগছে ব্যয়বহুল কাঁচামাল, উচ্চ জ্বালানি খরচ এবং পরিবহন ব্যয়ের জটিলতায়। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি প্রতিযোগিতায় দেশটি ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে।
পরিস্থিতি পাল্টাতে ভারতের বস্ত্র মন্ত্রণালয় এখন গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তন্তু ও কাপড়ের গুণমান উন্নয়ন, টেকসই উপাদান ব্যবহার, এবং ডিজিটাল ট্রেসিং ব্যবস্থার প্রয়োগ নিয়ে নতুন পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে।
একই সঙ্গে, ব্র্যান্ডিং, ডিজাইন উদ্ভাবন এবং তরুণ বস্ত্র উদ্যোক্তাদের (টেক্সটাইল স্টার্টআপ) বিকাশে সহায়তা করতে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি শিল্প সংগঠন, ব্যাংক, ইনোভেশন ল্যাব, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও স্টার্টআপগুলোর সঙ্গে একযোগে পরামর্শমূলক কর্মপরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে।
ভারতের চেম্বার অব কমার্সের টেক্সটাইল বিষয়ক জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান সঞ্জয় জৈন মনে করেন, “কোয়ালিটি কন্ট্রোল অর্ডার বাতিল, শ্রম আইনের সংস্কার, এবং ইউরোপের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি উৎপাদন ব্যয় কমাতে ও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।”
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ভারতের বস্ত্র ও পোশাক রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় মাত্র ০.৩৯ শতাংশ বেড়েছে—যা প্রবৃদ্ধির দিক থেকে প্রায় স্থবিরতা নির্দেশ করে।
২০২৪–২৫ অর্থবছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বৈশ্বিকভাবে টেকসই উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে। এর অর্থ, ভারতীয় বস্ত্রশিল্পকে পরিবেশবান্ধব ও সার্টিফায়েড উৎপাদন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে—যা ব্যয় আরও বাড়াতে পারে।
অতএব, ভারতের সামনে দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ—একদিকে খরচ কমিয়ে প্রতিযোগিতা বজায় রাখা, অন্যদিকে বৈশ্বিক মানদণ্ডে টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করা।
ভারতের জন্য মূল প্রশ্ন এখন—সে কি কম খরচের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ-ভিয়েতনামের সঙ্গে লড়বে, না কি উচ্চমান ও টেকসই বস্ত্র উৎপাদনে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করবে? ব্যয় রূপরেখা উদ্যোগটি এই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার প্রথম ধাপ। ●
অকা/তৈপোশি/ই/সকাল/২৯ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 hours আগে

