অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে এক বছরেরও বেশি সময় আগে ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যের প্রক্রিয়া শুরু করে বাংলাদেশ; তবে ভারসাম্যহীন আমদানি-রফতানি আর ব্যবসায়ীদের অনীহার কারণে সেটির পরিসর বাড়েনি এখনও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ডলারের পরিবর্তে রুপিতে বাণিজ্যের পদক্ষেপটি ভারতের সঙ্গে ব্যবসা কার্যক্রমে বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
হালনাদাগ তথ্য বলছে, রুপি দিয়ে ২০২৩ সালের ১১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৩ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার রুপির পণ্য রফতানি হয়েছে। আর একই সময়ে ভারত থেকে ২ কোটি ১০ লাখ ২৬ হাজার রুপির পণ্য আমদানি হয়েছে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে ইস্টার্ন ব্যাংক (ইবিএল), স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে রুপিতে বাণিজ্য হচ্ছে। এর মধ্যে ইবিএলের মাধ্যমে ১১ লাখ ৩০ হাজার রুপির পণ্য আমদানি হয়েছে। আর রফতানি হয়েছে ৭৩ লাখ হাজার ৫১ হাজার রুপির পণ্য।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মাধ্যমে ৪৮ লাখ ১৪ হাজার রুপির পণ্য আমদানি হয়েছে, রফতানি হয়েছে ৯৬ লাখ ২৯ হাজার রুপির। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে ১ কোটি ৫০ লাখ ৮১ হাজার কোটি রুপির পণ্য আমদানির বিপরীতে রফতানি হয়েছে ১ কোটি ৬১ লাখ রুপির পণ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, “যেহেতু আমরা ২০২২ সালে আরবিআইয়ের সঙ্গে রুপির ব্যবস্থা শুরু করেছি এই নীতির উপর ভিত্তি করে যে, ভারতে রফতানি করলে রুপি আয় হবে এবং ভারত থেকে কোনো কিছু আমদানি করতে চাইলে সেই রুপি দিয়েই আমদানির এলসি খোলায় ব্যবহার করা যাবে।
“যেহেতু ভারতে রফতানি কম হয়, তাই রুপিও কম আসে। সেজন্য আমদানির নিষ্পত্তি রুপিতে করা যায় না। সেজন্যই লেনদেন কম, আর ব্যবসায়ীরাও এলসি খুলতে আগ্রহ দেখান না।”
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বিশাল। ভারত থেকে গত কয়েক বছরে আমদানির পরিমাণ ১১ থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলারের মত। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় ২ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে, যার পুরোটা রুপিতে হলেও পার্থক্য থাকবে অনেক বেশি।
দেশে ডলার সংকট প্রকট হলে প্রধান এ বিদেশি মুদ্রার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে বাংলাদেশ ও ভারত ২০২৩ সালের ১১ জুলাই দুই দেশের বাণিজ্যে রুপি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে এক বছর পর ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে কোনো পণ্য আমদানি করতে হলে দেশের ব্যাংকে রুপিতে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে হবে। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকগুলোতে রুপি পর্যাপ্ত নেই। বাংলাদেশ থেকে রুপিতে রফতানি হলেই ব্যাংকগুলোতে রুপি আসবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি কম হওয়ায় রুপিতে আয় চাহিদার তুলনায় খুবই কম।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা রুপিতে ব্যবসা চালাতে আগ্রহী নন। আমদানির ঋণপত্র খোলার জন্য ব্যাংকে পর্যাপ্ত রুপি নেই। আর বৈদেশিক মুদ্রা ডলার দিয়ে বাণিজ্য কার্যক্রম সবজায়গাতেই স্বীকৃত ও সহজ।“
দুই দেশের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ”রুপিতে করতে হলেও তো এই বাণিজ্যে একটা সামঞ্জস্যতা আনতে হবে। নাহলে রুপি তো পাওয়া যাবে না।”
তার ভাষ্য, “ব্যাংকে তো রুপি নেই, থাকলেও তা কম। তাই ব্যবসায়ীরা রুপিতে ব্যবসা করতে চান না। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৩ সালে চালু করলেও বাজারে তা প্রভাব ফেলতে পারে নাই।”
সেসময় ঢাকার একটি হোটেলে রুপিতে বাণিজ্য শুরুর বিষয়টিকে একটি ‘বড় সূচনার প্রথম পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন ভারতীয় হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা।
রউফ তালুকদার তখন বলেছিলেন, “বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ঝুড়িতে থাকা ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনবে রুপির লেনদেন। বড় কোনো যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ এটি। সামনের দিকে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে আরও বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে এ উদ্যোগ।”
যদি এক বছরের বেশি সময় পরও রুপিতে বাণিজ্যের পরিসর বিস্তৃত হয়নি। এ বিষয়ে ইবিএলের করপোরেট ব্যাংকিংয়ের প্রধান আহমেদ শাহিন বলেন, “রুপিতে বাণিজ্য রফতানিকারকদের আগ্রহ কম। রফতানি কম হয়, তাই রুপিও আসে কম।”
প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে রুপিতে লেনদেনের প্রক্রিয়া চালু করতে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনে ভারতের ব্যাংকগুলোতে রুপিতে ‘নস্ট্র অ্যাকাউন্ট’ খোলা হয়। এই নস্ট্র হিসাব হল বিদেশের কোনো ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রায় লেনদেন করতে খোলা হিসাব।
ফলে ডলারের মাধ্যমে এলসি বা ঋণপত্র খোলার প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি রুপিতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য ভারতের ব্যাংক দুটিতে ঋণপত্র খুলতে পারেন দেশটির আমদানিকারকরা।
একইভাবে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যাংক দুটিতে ঋণপত্র খুলতে পারবেন আমদানিকারকরা।
বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য ভারতে রফতানি করবে, তার বিপরীতে প্রাপ্ত রফতানি আয়ের সমপরিমাণ অর্থের পণ্য আমদানি করা যাবে রুপিতে।
টাকার বিপরীতে রুপিতে বিনিময় হার ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ হার ধরে পণ্য আমদানি ও রফতানি খরচ নির্ধারণ করবে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলার আমদানি দায় পরিশোধ করা হয়। এর বিপরীতে রফতানি করা হয় ১৯৯ কোটি ডলার।
বিদেশি মুদ্রা লেনদেনে আর্থিক পরিষেবা হিসেবে আন্তর্জাতিক লেনদেন মাধ্যম সুইফট সিস্টেমকে ব্যবহার করা হয়। কোনো দেশের সঙ্গে বিদেশি মুদ্রায় বাণিজ্য লেনদেন নিষ্পত্তি করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্বীকৃত মুদ্রায় করতে হয়। সুইফট সিস্টেমে এখনও রুপি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
ইউএস ডলার, ইউরো, পাউন্ড, চীনের মুদ্রা ইউয়ান ও জাপানের ইয়েন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্বীকৃত মুদ্রা। এর বাইরের কোনো মুদ্রায় লেনেদেন করতে হলে প্রয়োজন হয় দ্বিপক্ষীয় চুক্তি। বাংলাদেশ ও ভারত নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে রুপিতে লেনদেন চালু করে। ●
অকা/বা/ই/সকাল, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 year আগে

