অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি হয়েছে তার একটা বড় প্রভাব আছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে। নতুন ড্যাপে ভবনের উচ্চতা এবং পরিধি এলাকা ভেদে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ফলে আবাসন ব্যবসায়ীরাও বাধ্য হচ্ছেন এপার্টমেন্টের দাম বৃদ্ধি করতে।
নির্মাণ সামগ্রীর দর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, চলমান মুদ্রাস্ফীতি এবং নতুন ড্যাপের (ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান) কারণে ফ্ল্যাটের দর এক বছরে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে এপার্টমেন্ট বিক্রয়ের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে কম বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীতে গতকাল শেষ হওয়া পাঁচদিনের আবাসন মেলাতেও ফ্ল্যাট-প্লট বিক্রি আগের বছরগুলোর তুলনায় কমেছে। গত বছরের তুলনায় দর্শনার্থীও তিন হাজারের বেশি কমেছে বলে জানিয়েছে আয়োজকরা।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর তথ্যমতে, ২১-২৫ ডিসেম্বর চলা মেলায় ৩৫১ কোটি টাকার অর্ডার পেয়েছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। এটি গত পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২১ সালের আবাসন মেলাতেও ৪০১ কোটি টাকার অর্ডার পেয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা।
রিহ্যাবের প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামীন কাজল বলেন যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি হয়েছে তার একটা বড় প্রভাব আছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে। নতুন ড্যাপে ভবনের উচ্চতা এবং পরিধি এলাকা ভেদে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ফলে আবাসন ব্যবসায়ীরাও বাধ্য হচ্ছেন এপার্টমেন্টের দাম বৃদ্ধি করতে।
তিনি বলেন, গত এক বছরে রড-সিমেন্টসহ নির্মাণ সামগ্রীর দর ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী বছর এপার্টমেন্টের দাম আরো ২০-৩০ শতাংশ বাড়াতে হবে। তাতে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই বিপাকে পড়বেন।
"রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের শহরগুলোতে প্রতিবছর যে পরিমান এপার্টমেন্ট ও প্লট বিক্রয় হয়, গত ৫ বছরের মধ্যে এবছর সবচেয়ে কম বিক্রয় হয়েছে," আলমগীর যোগ করেন।
ছোট ও মাঝারি আকারের ফ্ল্যাটের চাহিদা বেশি ছিল এবারের রিহ্যাব আবাসন মেলায়।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পাঁচদিনব্যাপী আবাসন মেলার সমাপনী দিনে রিহ্যাব জানায়, এবারের মেলায় প্রায় ৩০২ কোটি টাকার ফ্ল্যাট, প্লট এবং বাণিজ্যিক স্পেস বিক্রি এবং বুকিং হয়েছে। এর সাথে, রড-সিমেন্ট-সিরামিক শিল্পে যোগ হয়েছে আরও ৫০ কোটি টাকার অর্ডার।
এ বছর, মেলায় ১২৩টি আবাসন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪৫০টি এপার্টমেন্ট বিক্রয় ও বুকিং হয়েছে। প্রায় ৩০০ প্লট বিক্রয় ও বুকিং হয়েছে। দর্শনার্থী ছিল ১৭ হাজার।
এক বছর আগে ২০২১ সালের আবাসন মেলায় ১৫৫টি আবাসন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬৪০টি এপার্টমেন্ট বিক্রয় ও বুকিং হয়েছে। প্রায় ৪৫০টি প্লট বিক্রয় ও বুকিং হয়েছে। তখন ৪০১ কোটি টাকার ফ্ল্যাট, প্লট এবং বাণিজ্যিক স্পেস বিক্রয় ও বুকিং হয়েছিল। দর্শনার্থীর সংখ্যাও ছিল ২০ হাজারের কাছাকাছি।
ঘোষিত নতুন ডিটেইল এরিয়া প্লানিং (ড্যাপ)-এ ভবনের ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) হ্রাসের কারণে মূল ঢাকায় বেশিরভাগ ভবন হবে ৪ থেকে ৫ তলা। আগে যেগুলো আট থেকে দশ তলা পর্যন্ত করা যেত।
রিহ্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন, ফ্লোর কমার কারণে ভবনের উচ্চতা ও পরিধি কমেছে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। যে কারণে আবাসন ব্যবসায়ীরা এপার্টমেন্টের দাম বৃদ্ধি করেছে। এ কারণেও এপার্টমেন্ট কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা। অনেকেই কেনার পরিকল্পনা থাকলেও আপাতত কিনছেন না।
সদ্য শেষ হওয়া আবাসন মেলায় ছোট ও মাঝারি আকারের ফ্লাটের চাহিদা বেশি ছিল বলে জানিয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
শেলটেক লিমিটেডের সিনিয়র সহকারী জেনারেল ম্যানেজার একেএম রফিকুল ইসলাম জানান, "আমাদের ছোট-মাঝারি-বড়-লাক্সারি সব ধরনের ফ্লাটই আছে। তবে এবার ছোট ও মাঝারি ফ্লাটের চাহিদা একটু বেশি ছিল।"
একই কথা প্রতিধ্বনি করেন কনকর্ডের এক্সিকিউটিভ অফিসার আফজাল হোসেন: "সাধারণত ছোট ফ্লাটগুলো ১০০০-১৩০০ স্কয়ার ফুট ও মাঝারি ফ্লাটগুলো ১৩০০ থেকে ১৬০০ স্কয়ার ফিটের মধ্যে হয়ে থাকে। এগুলোর দাম এক থেকে আড়াই কোটি টাকার মধ্যে হয়। এবার এই ফ্লাটগুলো চাহিদার শীর্ষে আছে।"
ছোট ও মাঝারি ফ্ল্যাটের মতোই এবার চাহিদা বেশি ছিল তুলনামূলক কম দামের জায়গা উত্তরা-মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকার অ্যাপার্টমেন্টে।
রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট কামাল মাহমুদ জানান, যাতায়াত সুবিধা বাড়ায় এ বছর আবাসন মেলায় উত্তরা ও মিরপুর এলাকার ফ্ল্যাটের চাহিদা বহুগুণ বেড়েছে।
নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়) মো মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, "মিরপুরের দিকের কাস্টমার বেশি পাচ্ছি। অধিকাংশ গ্রাহকই রেডি ফ্ল্যাট খুঁজছেন।"
ক্রিডেন্স হাউজিং লিমিটেডের ম্যানেজার এবং টিম লিডার (পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ) রেজাউল করিম বলেন, "মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডে, হুমায়ুন রোড, বাবর রোডের রেডি ফ্ল্যাটগুলো গ্রাহকরা বেশি দেখছেন।"
এবারের আবাসন মেলায় অংশগ্রকণকারী আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, এবার মোহাম্মদপুরের পাশাপাশি মিরপুর, ধানমন্ডি, উত্তরার, খিলগাঁও এলাকার দিকের ফ্ল্যাটেরও বেশি চাহিদা রয়েছে।
রিহ্যাব সহ-সভাপতি সোহেল রানা বলেন, এবারে আবাসন বরাবরের মতো মেলায় মধ্যবিত্তরাই বেশী এপার্টমেন্ট ও প্লাট কিনেছেন।
তবে একটি লাক্সরি এপার্টমেন্ট বিক্রয় আবাসন কোম্পানির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, লাক্সারি এপার্টমেন্ট বিক্রয় কমেনি। বরং আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ৮ কোটি টাকা থেকে শুরু করে ৪০ কোটি টাকা পর্যন্ত তারা লাক্সারি এপার্টমেন্ট তৈরি করে বিক্রয় করেন।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মহিবুর রহমান। তিনি এবারের রিহ্যাবের অবাসন মেলায় মোহাম্মদপুর এলাকায় ক্রিডেন্স হাউজিং এর একটি এপার্টমেন্ট বুকিং দিয়েছেন।
মহিবুর রহমান বলেন, "তিন বছর ধরেই এপার্টমেন্ট ক্রয়ের জন্য চেষ্টা করছি। প্রতিবছর দাম বাড়ছে। ৯৫ লাখ টাকা দামের ১৩৫০ স্কয়ার ফুটের একটি এপার্টমেন্ট বুকিং দিয়েছি। মেলায় ১৫ লাখ টাকা এডভান্স করেছি। এবার কিনতে না পরলে আগামী বছর আরো দাম বৃদ্ধি পাবে, সে চিন্তা থেকে একটু বেশ দাম হলেও এবার কিনেছি। বাকি টাকা একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার চুক্তি হয়েছে।"
ডিরেক্টরেট অফ রেজিস্ট্রেশনের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবগুলো সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার এপার্টমেন্ট বিক্রয় চুক্তির নিবন্ধন হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকার আওতাধীন এলাকায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের বিক্রয় চুক্তির নিবন্ধন হয়েছে।
গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩৫,০০০ কোটি টাকার এপার্টমেন্ট বিক্রয় চুক্তির নিবন্ধন হয়েছে। ২০২০ সালে প্রায় ৩১,৫০০ কোটি, ২০১৯ সালে প্রায় ৩৮,০০০ কোটি এবং ২০১৮ সালে প্রায় ২৯,৬০০ কোটি টাকার এপার্টমেন্ট বিক্রয় চুক্তির নিবন্ধন হয়েছে।
ডিরেক্টরেট অফ রেজিস্ট্রেশনের সহকারি মহা-পরিদর্শক শেখ মো. আনোয়ারুল হক বলেন, "কোভিড চলাকালে যে পরিমাণ এপার্টমেন্ট, ফ্লাট, কমার্শিয়াল স্পেস, কমার্শিয়াল প্লট বিক্রয় চুক্তি হয়েছে, এ বছরের সেপ্টম্বর পর্যন্ত তার অর্ধেকও বিক্রয় চুক্তি নিবন্ধন হয়নি। বিশেষ করে এপার্টমেন্ট এ বছর সবচেয়ে কম বিক্রি হয়েছে।"
ডেলটা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও নাসিমুল বাতেন বলেন, "গতবছর হাইজিং সেক্টরে যে পরিমান ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত সেটি একইরকম ছিল। তবে জুলাই মাসের পর থেকে প্রায় ১০ শতাংশ ঋণ বিতরণ কম হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "আমাদের মূল ঋণগ্রহীতা হলো আবাসন কোম্পানিগুলো। রাশিয়া উক্রেনের যুদ্ধের কারণে, সবরকম হাউজিং মেটারিয়ালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অনেকেই নতুন করে কোনো প্রকল্প নিতে পারছে না। আবার নতুন ড্যাপের কারণে আবাসন ব্যবসায়ীরা নতুন প্রকল্প নিতে পারছে না। তাই ঋণ নেয়ার পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছেন তারা।"
২০২২ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ড আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেয় টাকার উৎস কোথা থেকে এসেছে তাতে নজর না দিয়েই।
আলমগীর শামসুল আলামীন কাজল মনে করেন এই অর্থবছরের বাজেটে এই সুযোগ বাদ দিয়ে দেওয়ায় আবাসন খাতের বিক্রি ধীর হয়ে পড়েছে।
২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর আবাসন খাতে গড়ে দেড় লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। ২০২২ অর্থবছরে অতিরিক্ত আরও ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে টাকার উৎস গোপন রাখা বিনিয়োগকারীদের ক্ষমা ঘোষণা করায়।
সবমিলিয়ে এ বছর আবাসন খাতে নতুন বিনিয়োগ এক লক্ষ কোটি টাকার নিচে নেমে আসতে পারে বলে জানান তিনি। #
অকা/আখা/দুপুর, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 years আগে

