অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রাবাজার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার ক্রয় ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। প্রবাসী আয়ের শক্তিশালী প্রবাহের কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে ডলার কিনছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য একদিকে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে শক্তিশালী করা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম৬ হিসাবপদ্ধতিতে রিজার্ভের পরিমাণ ২৮ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার, যা প্রায় তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে প্রধান চালিকা শক্তি হলো রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক প্রবাহ এবং বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্রিয় ডলার ক্রয়।

চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২৭ দিনেই প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রায় ২৭৫ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১ হাজার ৫৭৯ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। এর আগে গত অর্থবছরে রেকর্ড ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে। এই উচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে।

অন্যদিকে রপ্তানি আয়ের গতি তুলনামূলকভাবে দুর্বল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রপ্তানি আয় বেড়েছে এক শতাংশেরও কম। বিশ্লেষকদের মতে, রপ্তানি আয়ে এই নিম্নগতি থাকলেও রেমিট্যান্সের শক্তিশালী প্রবাহ ডলারের বাজারকে স্বস্তিতে রেখেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজার থেকে ডলার কেনার সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করছে।

ডলার বাজারে অস্থিরতার সূচনা হয়েছিল ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে। তখন ডলারের সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করে বাজারে সরবরাহ বাড়ায়। এর ফলে আগের সরকারের শেষ দিকে রিজার্ভ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় এবং ডলারের দাম ১২০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। সেই সময় ডলারের সংকট ও দরবৃদ্ধিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল। আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলারের দর প্রায় ১২২ টাকায় স্থির রয়েছে এবং ব্যাংকগুলোতে ডলার পেতেও তেমন সমস্যা হচ্ছে না। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমদানিতে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপও কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর শেষে দেশে মূল্যস্ফীতির হার নেমে এসেছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে।

চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলো থেকে মোট ৩০৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার কিনেছে, যার বিপরীতে বাজারে ছাড়া হয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। শুধু ডিসেম্বর মাসেই কেনা হয়েছে ৯২ কোটি ডলার, আর এর বিপরীতে বাজারে সরবরাহ করা হয়েছে ১১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার বেশি। মূলত গত জুনে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ যোগ হওয়ার পর জুলাই মাসে ডলারের দর নেমে আসে ১১৯ টাকা ৫০ পয়সায়। সেই সময় থেকেই বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ সামাল দিতে ডলার কেনার কৌশল জোরদার করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সের শক্ত ভিত, স্থিতিশীল ডলার বাজার এবং বাড়তে থাকা রিজার্ভ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় কিছুটা স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে রপ্তানি আয় বাড়ানো এবং দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নীতিগত সমন্বয় অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তার কথাও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 1 day আগে

Leave A Reply

Exit mobile version