অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
দেশের শেয়ার বাজার যেন এক দীর্ঘমেয়াদি ধসের ঘূর্ণাবর্তে আটকে গেছে। টানা ১৪ মাস ধরে সূচকের উত্থান-পতনের এই ধারায় দেখা যাচ্ছে—এক দিন সামান্য বাড়লেও পরের কয়েক দিনেই সেই বৃদ্ধি মিলিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখন প্রায় ভেঙে পড়েছে। বাজারসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এই সংকটময় সময়েও সরকারের মনোযোগ সীমিত, ফলে বাজার কার্যত দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গত এক বছরে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না আসায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)—দুটি প্রধান বাজারেই একের পর এক বড় দরপতনের রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বাজারে অনিশ্চয়তার মূলে রয়েছে ইসলামী ভিত্তিক পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়া এবং নয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের উদ্যোগ। এসব সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে তীব্র শঙ্কা তৈরি করেছে, যার প্রভাব হিসেবে শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়েছে এবং সামগ্রিক বাজারমূলধন কমে যাচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, অনিশ্চয়তার অন্যতম উৎস হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করে “ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক” নামে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগ। সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো, এই নতুন ব্যাংকে পুরনো শেয়ারহোল্ডারদের কোনো অংশীদারিত্ব থাকবে না। অর্থাৎ, যারা বহু বছর ধরে এই ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের পুঁজিই এখন শূন্যে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নতুন ব্যাংকে নতুন শেয়ার ইস্যু করা হবে, এবং আগের বিনিয়োগকারীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এতে অন্তর্ভুক্ত হবেন না। ঘোষণাটি বাজারে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসই সূচক নেমেছে প্রায় ১৩২ পয়েন্ট এবং বাজারমূলধন কমেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দাম এক বছরে ৫.৪০ টাকা থেকে নেমে ১.৯০ টাকায় দাঁড়িয়েছে—পতনের হার প্রায় ৬৫ শতাংশ।
বিনিয়োগকারীদের এই ক্ষতির ঝুঁকি বিবেচনা করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গভর্নর বরাবর চিঠি পাঠিয়ে চার দফা প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—একীভূত ব্যাংকের সম্পদ ও দায় সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে শেয়ারহোল্ডারদের অংশ নির্ধারণ, দায়ী উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ন্যূনতম স্বার্থমূল্য নিশ্চিত করা এবং চূড়ান্ত মূল্যায়ন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে তালিকাচ্যুত না করা।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম মনে করেন, ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে একীভূতকরণ প্রয়োজন হতে পারে, তবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে এই সিদ্ধান্ত পুরো বাজারকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাঁর ভাষায়, “ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা না থাকলে আস্থা কখনোই ফিরবে না।” তিনি জানান, ডিবিএ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে আলোচনায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববাজারের অধিকাংশ দেশেই শেয়ার সূচক বেড়েছে—দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও পাকিস্তানের বাজারে যথাক্রমে ১০, ৯ ও ৭.৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। বিপরীতে, বাংলাদেশের বাজারে পতন হয়েছে ৩.২০ শতাংশ। অর্থাৎ, স্থানীয় রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও বিনিয়োগ স্থবিরতা মিলেই বাজারকে নেতিবাচক ধারা থেকে বের হতে দিচ্ছে না।
সবশেষে স্পষ্ট হচ্ছে—শেয়ার বাজারে যে আস্থাহীনতার গভীরতা তৈরি হয়েছে, তা থেকে মুক্তি পেতে হলে দরকার বাস্তবভিত্তিক সংস্কার, স্বচ্ছ নীতিমালা এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা। বাজারে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও নিরবচ্ছিন্ন তদারকি নিশ্চিত না করা গেলে পতনের এই ধারা আরও দীর্ঘমেয়াদি আকার নিতে পারে, যার প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ওপর। ●
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/১৪ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 hours আগে