অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের ভেতর জমে থাকা অনিয়ম ও ঋণখেলাপির প্রকৃত চিত্র একে একে উন্মোচিত হচ্ছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশ। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ অঙ্কের খেলাপি ঋণ, যা পুরো খাতের স্থিতিশীলতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, হঠাৎ খেলাপি ঋণ এত দ্রুত বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূলত তিনটি প্রধান কারণ কাজ করছে। প্রথমত, শেখ হাসিনার সময়ে বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে বিপুল অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছিল, যা তখন গোপন রাখা হয়েছিল রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের কারণে। সরকার পরিবর্তনের পর সেই গোপন ঋণগুলোর প্রকৃত হিসাব এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে, যা মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণকে হঠাৎ করে ফুলিয়ে তুলেছে।

দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে খেলাপি ঋণ ঘোষণার সময়সীমা আগের ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাসে আনা হয়েছে। ফলে পূর্বে যেসব ঋণ এখনো খেলাপির আওতায় পড়েনি, সেগুলো এখন হিসাবের মধ্যে চলে এসেছে। এতে করে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের অঙ্ক হঠাৎ বেড়ে গেছে।

তৃতীয়ত, কৃষি ও ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পখাতে (এসএমই) খেলাপি ঘোষণায় আগে যেসব বিশেষ ছাড় দেওয়া হতো, সেই সুবিধাও এখন বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে এসব খাতে বহু ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা খেলাপির তালিকায় যুক্ত হয়েছেন।

এদিকে, ব্যাংক খাতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের আনুষ্ঠানিক সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৪৮৩ জন। এরা সচেতনভাবে ঋণ পরিশোধ না করে তা অন্য খাতে সরিয়ে ফেলেছেন বা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে ব্যাংক খাতে নতুন এক ধস নেমে আসবে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, “ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের টাকা দেশে নেই, তা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এই অর্থ ফেরত আসবে—এমন আশা করারও কারণ দেখি না। তাই দ্রুত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তাদের বিচার করতে হবে, যাতে কোনো আপিলের সুযোগ না থাকে। অথবা হাইকোর্টে আলাদা বেঞ্চ গঠন করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা নিতে হবে; দীর্ঘদিন মামলা ঝুলিয়ে রাখা চলবে না।”

অন্যদিকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, “শুধু ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সংখ্যা প্রকাশ করলেই হবে না, তাদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। নাম-ঠিকানা প্রকাশ না করলে দায়বদ্ধতা তৈরি হবে না। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে সম্পদ জব্দ, বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধকরণ এবং মামলা দায়েরসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু তথ্য সংরক্ষণ করলে কোনো ফল মিলবে না।”

দেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে যে সংকটে পড়েছে, তা কেবল আর্থিক নয়—এটি প্রশাসনিক ও নৈতিক দুর্বলতার প্রতিফলনও বটে। গোপন ঋণ, প্রভাবশালী মহলের আশ্রয় এবং শিথিল তদারকি ব্যবস্থার কারণে এ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এখন প্রয়োজন বাস্তবসম্মত ও সাহসী পদক্ষেপ, যাতে ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং জনগণের আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/৭ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 7 days আগে

Leave A Reply

Exit mobile version