অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
গেল মাস অক্টোবর ২৬ মাসের সর্বনিম্ন হয়েছে বাংলাদেশের পণ্যদ্রব্য রফতানি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুসারে যা জানা গেছে। ইপিবি জানায়, গেল মাসে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কমে রফতানিমূল্য ৩৭৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
আগের বছরের একই মাসে মোট রফতানিমূল্য ছিল ৪৩৫ কোটি ডলার, সে তুলনায় এটি বড় পতনেরই ঘটনা।
তৈরি পোশাক, পাট ও পাটপণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল ও কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান সব খাতেই রফতানি পারফরম্যান্সের মন্দ দশা দেখা গেছে। এসব খাতে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে।
এদিকে গত কয়েক মাস ধরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত হ্রাস পাচ্ছে, রফতানিতে পতনের ঘটনা সরকারের মুদ্রা রিজার্ভকে চাঙ্গা করার প্রচেষ্টাকে আরও কঠিন করে তুলবে। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন বা দুই হাজার কোটি ডলারের নিচে– যা দিয়ে মাত্র তিন মাসের আমদানি দায় মেটানো যাবে।
এই পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সহ প্রধান রফতানি বাজারগুলোতে চাহিদার অভাব এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, সংঘাত দায়ী বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা।
এ ছাড়া, গত ২৩ অক্টোবর থেকে আশুলিয়া ও গাজীপুরের মতোন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতের প্রধান কেন্দ্রগুলোতে যে শ্রমিক আন্দোলন চলছে, সেটিও রফতানি চালানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে জানান তারা।
আলাপকালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বিজিএমইএ'র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, অক্টোবর থেকে প্রতিকূল অবস্থার শিকার হয় পোশাক খাত, ফলে বছরওয়ারি ও মাসিক উভয় হিসাবেই প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে।
তিনি জানান, সেপ্টেম্বরের তুলনায় পোশাকের রফতানি চালান ১২ দশমিক ৫ শতাংশের মতোন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে অক্টোবরে। আর আগের বছরের একই মাসের তুলনায় তা প্রায় ১৪ শতাংশ কম হয়েছে।
প্রধানত দুটি কারণ: বিশ্ববাজারে চাহিদা হ্রাস এবং চলমান শ্রমিক আন্দোলনের ফলে সরবরাহ চক্র ব্যাহত হওয়াকে তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেন।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, রফতানির মূল্যপতনে শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে ৫০০ কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রফতানি কমলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হ্রাস পায়, এতে আমদানি বিল ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া, রফতানিতে ধারাবাহিকভাবে পতন হলে তা বাণিজ্যের ভারসাম্যকে আরও জটিল করে তোলে। এতে বাণিজ্য ঘাটতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং ঋণ নেওয়ার খরচও বেড়ে যায়।
পোশাকখাত একটি শ্রম-ঘন শিল্প, তাই রফতানি কমলে– কর্মী ছাঁটাই হতে পারে। এতে শ্রমিকদের জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এবং শ্রমিক অসন্তোষ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)- এর গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'আমরা যখন রিজার্ভ পুনর্গঠনের চেষ্টা করছি, এরমধ্যে আশাব্যঞ্জক খবর তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। অক্টোবরে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা সুসংবাদ আসলেও, রফতানিতে কোন ভালো খবর নেই।'
প্রধান দুটি বাজারে চাহিদা কমার বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের বাজার পরিস্থিতি ভালো নয়, আবার জার্মানির অর্থনীতিও মন্থর হয়ে পড়েছে, যা এসব দেশে পোশাকপণ্যের চাহিদা কমাচ্ছে।'
চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার আবহ এবং শ্রমিক আন্দোলন এসব দেশে রফতানির সরবরাহ শৃঙ্খলকে আরও ব্যাহত করবে বলেও মন্তব্য করেন এ অর্থনীতিবিদ।
'পরিস্থিতির উন্নতি নাহলে, সাপ্লাই চেইনে আরেকটি বড় ব্যাঘাত ঘটবে। নভেম্বর মাসের রফতানি আয়ে আমরা সেটার প্রতিফলন দেখব'- যোগ করেন ড. রাজ্জাক।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, বিশ্ববাজারে অর্থনৈতিক মন্থরতা এবং চাহিদা কমে যাওয়ার ঘটনায় রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী কিছু দেশ, যেমন পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন বাংলাদেশের চেয়েও বেশি হারে করেছে। এটিও দেশের পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এর পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতিও চিন্তার কারণ। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় যা বাংলাদেশের বেশি। অর্থাৎ, বাংলাদেশে উৎপাদনও খরচও বেশি হচ্ছে। 'অন্যরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে, শুধু আমরাই তা পারিনি'- যোগ করেন তিনি।
এইক্ষেত্রে প্রতিযোগী ভিয়েতনামের উদাহরণ টেনে ড. রাজ্জাক বলেন, তারা কিন্তু বাংলাদেশের মতো মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেনি, কিন্তু মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার মাধ্যমে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রেখেছে।
তার মতে, 'বাংলাদেশ এসব বিষয় সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে, এমন সময়ে চাপ তৈরি হবে– যখন আমরা মুদ্রা রিজার্ভ পুনর্গঠন করে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে চাইছি।'
ইপিবির তথ্যমতে, অক্টোবরে বাংলাদেশের রফতানির প্রধান চালিকাশক্তি পোশাকখাতের অংশ ছিল ৩১৬ কোটি ডলার, আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় যা কমেছে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
পোশাকখাতের মধ্যে নিটওয়্যার রফতানি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ কমে ১৯১ কোটি ডলারের হয়েছে। উভেন আইটেমের রফতানি ২১ দশমিক ৯ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ১২৫ কোটি ডলারে।
রফতানির অন্যান্য খাতের মধ্যে কৃষিপণ্য, এবং পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি যথাক্রমে ১ দশমিক ৩ এবং ১৬ দশমিক ১ শতাংশ কমেছে।
চামড়াজাত পণ্য এবং হোম টেক্সটাইল রফতানিতে পতন হয়েছে যথাক্রমে ৪২ দশমিক ২ এবং ৩৮ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে, কেবলমাত্র তুলা ও তুলাজাত পণ্য এবং প্রকৌশল পণ্য যথাক্রমে ৩৬ দশমিক ৪ ও ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
অক্টোবর মাসে রফতানি কমলেও– সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ের রফতানি পারফরম্যান্স ইতিবাচক রয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এসময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। অবশ্য, সরকার ঘোষিত ৯ দশমিক ৩১ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তা অনেকটাই কম।
অকা/র/ সকাল/০৪ নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 years আগে

