অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে শেয়ার বাজারে প্রতারণার ঘটনা দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। প্রতারক চক্রগুলো সুপরিচিত বাজার বিশ্লেষক ও প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে বিনিয়োগকারীদের শত শত গুণ মুনাফার লোভ দেখাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) নিয়মিতভাবে সতর্কবার্তা দিলেও প্রতারণা কার্যত বন্ধ হচ্ছে না। বরং প্রতারকরা প্রযুক্তির সহায়তায় আরও চতুর উপায়ে বিনিয়োগকারীদের ফাঁদে ফেলছে।
প্রতারকরা সাধারণত ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে চটকদার বিজ্ঞাপন ছড়ায়। এরপর আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত করে। এসব গ্রুপে ভুয়া মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে বিনিয়োগ করাতে চাপ সৃষ্টি করা হয়। সম্প্রতি একটি প্রতারকচক্র নতুন অ্যাপ চালুর ঘোষণা দিয়েছে, যা প্রমাণ করে তারা নির্বিঘ্নে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বিএসইসি যখন এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়, তখন তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)-এর সহায়তা চায়। এনটিএমসি দেশের টেলিযোগাযোগ ও অনলাইন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে থাকে। তবে এখনো পর্যন্ত এই সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপের কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি, ফলে প্রতারকরা নির্বিঘ্নে সক্রিয় থেকে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতারকরা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের লোগো ব্যবহার করছে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সহজেই প্রতারিত হচ্ছেন। বিদেশেও এই ধরনের প্রতারণা ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়েছে। এফবিআই-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে কেবল এ ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভারতে ২০১৪ সালে প্রায় ৫ বিলিয়ন রুপি একই পদ্ধতিতে প্রতারণার শিকার হয়। যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও নাইজেরিয়াতেও এর নজির রয়েছে।
বর্তমানে প্রতারকরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে শত শত ভুয়া বিজ্ঞাপন তৈরি করছে। এসব বিজ্ঞাপনে বিনিয়োগের ওপর ৩০০ থেকে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত রিটার্নের প্রলোভন দেখানো হয়। শুরুতে বিনিয়োগকারীদের অল্প টাকার মুনাফা উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হয়, যাতে তাদের আস্থা অর্জন করা যায়। পরে বড় অঙ্কের বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করা হয়। "আজকের জন্য বিশেষ সুযোগ", "ভিআইপি এআই মডেল" কিংবা "শীর্ষ বিনিয়োগকারীদের জন্য বোনাস" ধরনের বার্তা দিয়ে তাদের চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু যখন বিনিয়োগকারীরা মূলধন ফেরত চাইতে যান, তখন তাদের অতিরিক্ত "ট্যাক্স", "যাচাই ফি" বা "ওয়ালেট আপগ্রেড ফি" দেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়। এভাবে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর প্রতারকরা উধাও হয়ে যায়।
বাংলাদেশে এ সমস্যার বিরুদ্ধে কিছু প্রচেষ্টা নেওয়া হলেও সেগুলো কার্যকর হয়নি। বিএসইসি ও ডিএসই বেশ কয়েকবার সতর্কবার্তা দিয়েছে এবং সংবাদ সম্মেলনও করেছে। কিন্তু প্রতারণা ঠেকাতে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি তাদের হাতে নেই। এক কর্মকর্তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, "এই ধরনের প্রতারণা বন্ধ করার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই।" বিএসইসি-এর মার্কেট ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট এনটিএমসি-কে চিঠি দিয়ে এআই-নির্ভর প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক করেছে এবং নির্দিষ্ট হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু প্রতারকরা একাধিক গ্রুপ ও ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে, ফলে একটি গ্রুপ বন্ধ করলেও সমস্যা সমাধান হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের প্রতারণা মোকাবিলায় প্রযুক্তিভিত্তিক সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। শুধু সতর্কবার্তা নয়, উন্নত সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক নজরদারি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে অনভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবেন এবং শেয়ারবাজারের প্রতি আস্থা কমে যাবে। ●
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 5 days আগে