অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশে দ্রুত বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে এবার সরকার নিচ্ছে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিদ্যমান আইনি কাঠামোকে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করতে ‘অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশ ২০২৫’ চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যেখানে প্রথমবারের মতো আদালতকে বিদেশে পাচার করা অর্থ ও সম্পদ অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে।
এ অধ্যাদেশ কার্যকর হলে অর্থঋণ আদালত শুধু দেশের ভেতরেই নয়, বরং বিদেশেও ঋণের অর্থ অপব্যবহার বা পাচারের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের খোঁজ নিতে পারবে। আদালত চাইলে সেই সম্পদ শনাক্ত ও পুনরুদ্ধারে আইনি প্রক্রিয়া চালাতে পারবে। সরকারের লক্ষ্য—এই নতুন ক্ষমতার মাধ্যমে ব্যাংক খাতে ঋণের শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও খেলাপি ঋণ আদায়ের গতি বাড়ানো। সূত্র জানিয়েছে, খসড়াটি ইতোমধ্যে অর্থ উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হয়েছে এবং আপত্তি না থাকলে অচিরেই এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি হবে।
খসড়া অনুযায়ী, নতুন অধ্যাদেশে অর্থঋণ আদালতকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করা হচ্ছে। আদালত এখন থেকে খেলাপি ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের ব্যবহার স্থগিত, নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে থাকার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপের ক্ষমতা পাবে। এছাড়া আদালত বিদেশে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আইনি সহায়তা চেয়ে সেই সম্পদ ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর অর্থ উপদেষ্টাকে পাঠানো এক চিঠিতে লিখেছেন, অধ্যাদেশটি বাস্তবায়ন হলে তিনটি বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে—খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের সময়সীমা নাটকীয়ভাবে কমবে, প্রয়োগ প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী হবে এবং আর্থিক খাতের সামগ্রিক সুশাসন ও দায়বদ্ধতা বাড়বে। তার ভাষায়, “এই পরিবর্তনগুলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে এবং শ্রেণীকৃত ঋণ কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।”
নতুন অধ্যাদেশে মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে—৯০ দিনের মধ্যে রায় প্রদান বাধ্যতামূলক, বিশেষ ক্ষেত্রে আরও ৩০ দিন পর্যন্ত সময় বাড়ানো যাবে এবং সময়সীমা অতিক্রম হলে সীমিত পরিসরে আপিলের সুযোগ থাকবে। ‘রিকভারি সার্টিফিকেট’ নামে একটি নতুন কার্যকরী ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব রয়েছে, যার মাধ্যমে আদালতের রায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করবেন বিশেষভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত রিকভারি অফিসার। একই মামলায় একাধিক কার্যকর মামলা দায়েরের প্রচলিত প্রথা বিলুপ্ত করার বিধানও রাখা হয়েছে। জামানতদারদের অগ্রাধিকার দিয়ে পুরো কার্যকরীকরণ প্রক্রিয়া ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে, বিশেষ ক্ষেত্রে ৬০ দিন বাড়ানো যাবে। আদালত প্রয়োজনে মামলা দায়েরের আগেই নিষেধাজ্ঞা, সম্পদ জব্দ, রিসিভার নিয়োগ বা দেওয়ানি আটকাদেশ দিতে পারবে। সর্বোচ্চ আটকাদেশের মেয়াদও ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছর করা হয়েছে।
অধ্যাদেশে অভিজ্ঞ বা প্রশিক্ষিত বিচারকদের একটি বিশেষ পুল থেকে নিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে, যাতে মামলার গুণগত মান ও বিচার দক্ষতা নিশ্চিত করা যায়। পাশাপাশি, ‘অর্থঋণ আপিল আদালত’ গঠন করা হবে, যা নিচের আদালতের রায় পর্যালোচনা ও প্রয়োগের তদারকি করবে।
এর আগে ২০১৯ সালে সরকার ‘অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেখানে খেলাপি ঋণের তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ ও পৃথক আদালত গঠনের প্রস্তাব ছিল, তবে তা পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে দেশের অর্থঋণ আদালতগুলিতে মামলা জট অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ২০ হাজার ৫৯৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে, এর মধ্যে ৩ হাজার ২৬৯টি মামলা ঝুলছে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে, আর উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে আটকে আছে আরও ৪২টি মামলা। শুধু ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতেই বিচারাধীন খেলাপি ঋণের মামলা ৮ হাজার ৫৭৮টি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রায় ঘোষণার পরও খেলাপিরা উচ্চ আদালতে রিট করে মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখছেন। ফলে অর্থঋণ আদালতের রায় কার্যকর হচ্ছে না। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শীর্ষ খেলাপিদের অনেক মামলাতেই উচ্চ আদালতে একাধিক রিট রয়েছে—কোনো কোনো মামলায় একটি রায়ের বিপরীতে আটটি পর্যন্ত রিট করা হয়েছে। অনেক মামলা শুনানির তালিকায় থাকলেও কার্যতালিকায় খুব নিচে চলে যায়, ফলে শুনানি হয় না। এই প্রেক্ষাপটে অর্থঋণ আদালতকে অনুসন্ধান ও প্রয়োগ ক্ষমতায় শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, অর্থঋণ আদালতকে অনুসন্ধান ক্ষমতা দেওয়ার চেয়ে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপিকে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা গেলে বেশি কার্যকর হবে। কারণ ট্রাইব্যুনালে গেলে উচ্চ আদালতে রিটের সুযোগ থাকবে না, ফলে মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫ সালের জুন নাগাদ তা আরও বেড়ে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছায়—অর্থাৎ এক বছরে বৃদ্ধি প্রায় ৩ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, খেলাপি ঋণ এখন ৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি, যা ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতার জন্য সরাসরি হুমকি।
অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশ ২০২৫ কার্যকর হলে এটি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য এক বড় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ হতে পারে। বিদেশে পাচার হওয়া ঋণের অর্থ অনুসন্ধান, দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া, কঠোর শাস্তিমূলক বিধান ও রিকভারি সার্টিফিকেট ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে এটি ব্যাংক ঋণ পুনরুদ্ধার ব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বাস্তবায়ন। আইন যতই শক্তিশালী হোক, প্রয়োগ দুর্বল থাকলে খেলাপি ঋণের পাহাড় আরও উঁচু হবে, আর অর্থনীতির ভিত্তি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/৩ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 16 hours আগে

