অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
তারল্য সংকটে থাকা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য বিকল্প তহবিল দেয়ার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিলের মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তহবিল সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সূত্র মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি সত্ত্বেও তারল্য উদ্বৃত্ত থাকা ব্যাংকগুলো টাকা ধার দিতে গড়িমসি করছে। আবার ধার দেয়ার প্রক্রিয়া ধীর হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর সংকট উত্তরণে তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই তারল্য সংকটে থাকা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য ‘বিকল্প তহবিল’ দেয়ার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে বাজার থেকে তারল্য তুলে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দেয়ার কথা ভাবছে। ১৮০ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজার থেকে এই অর্থ তোলা হবে। যদিও সাধারণত এ ধরনের বিলের মেয়াদ ৩০ দিন হয়ে থাকে।
এ নিলামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বাংলাদেশে নিবাসী সকল ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ১০ লাখ টাকা বা ১০ লাখ টাকার গুণিতক অঙ্কের অভিহিত মূল্যে বিড দাখিল করতে পারবেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাব পরিচালনাকারী যে কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব বা তাদের ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী গ্রাহকদের পক্ষে বিড দাখিল করতে পারবেন।
এ পদ্ধতিতে সহায়তা করলে টাকা ছাপানো হবে কিনা- জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ পদ্ধতিতে দিলে সেটা টাকা ছাপানোর মধ্যে পড়বে না। কারণ যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে তুলে আনবে। একই অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেবে। ফলে বাজারের টাকা বাজারেই থেকে যাবে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী তারল্য সহায়তাও পাবে। গভর্নর হিসেবে ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলো হলো - ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে আগে থেকেই এ ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগের অবস্থা নাজুক ছিল। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নতুন টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংককে তারল্যের জোগান দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর অনৈতিক সে প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে ওঠে। আমানত তুলে নিতে বাড়তে থাকে গ্রাহকদের ভিড়। বিপরীতে নতুন করে টাকা জমা না হওয়ায় কিছু ব্যাংকের ‘ক্যাশ কাউন্টার’ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এ ব্যাংকগুলো ছাড়াও আগে থেকেই আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল।
সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে এতদিন তারল্য উদ্বৃত্ত থাকা ব্যাংক থেকে ধার দেয়া হচ্ছিল। এ প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার ৫০ কোটি টাকা ধার দেয়া হয়েছে। তবে আমানতকারীদের চাহিদার বিপরীতে এসব ধার খুবই কম হওয়ায় সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে মুদ্রা বাজার থেকে তারল্য তুলে সংকটে থাকা ব্যাংকের পাশে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
পর্ষদ ভেঙে দেয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তারল্য সংকট চলছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিতে। এ ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকরা চাহিদা অনুযায়ী আমানতের অর্থ তুলতে পারছেন না। কিছু ব্যাংকের এটিএম বুথ, আরটিজিএস ও এনপিএসবির মতো সেবা বন্ধ রয়েছে।
গত সোমবার সংকটে থাকা দুটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডির সঙ্গে বৈঠক করেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। বৈঠকে অংশ নেয়া ব্যাংক চেয়ারম্যান ও এমডিরা বলছেন, গভর্নরের পক্ষ থেকে ব্যাংকের ‘ক্যাশ কাউন্টার’ স্বাভাবিক করার জন্য কত টাকার প্রয়োজন সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকের ঋণ আদায় পরিস্থিতিসহ সংকট উত্তরণে আমরা কী করছি, আরও কী করণীয় রয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা হয়। ব্যাংকগুলোর সংকট কাটাতে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে বলে আভাস দেন গভর্নর।
শুরুতে কঠোর অবস্থানে থাকলেও এক মাস ধরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড় করাতে নানামুখী পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে। ১৮ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশের সব ব্যাংককে রক্ষা করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। পরিচালনায় বদল এনেও যেসব ব্যাংক এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সব আমানতকারীকে রক্ষা করা হবে। আমাদের লক্ষ্য হলো প্রত্যেক আমানতকারীকে সুরক্ষা দেয়া। অনিয়মের মাধ্যমে যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছেন, সেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠানকে মরতে দেয়া হবে না। কারণ সব প্রতিষ্ঠান জাতীয় সম্পদ। এর সঙ্গে ব্যাংকের বিনিয়োগ, উৎপাদন ও সরবরাহ জড়িত। সেটি এস আলম হোক কিংবা বেক্সিমকো।’ ●
অকা/ব্যাংখা/ই/ সকাল, ২৭ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 11 months আগে

