অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বৈশ্বিক সংকট ও মূল্যস্ফীতির প্রতিঘাতের মুখে পড়েছে রফতানি খাত। তলানি থেকে রিজার্ভ উপরে তোলার অন্যতম নিয়ামক রফতানি খাতে মার্কিন ডলার আয়। কিন্তু আগামী বাজেটে এ খাত থেকে কমছে প্রত্যাশা। কারণ দেশের রফতানিপণ্যের প্রধান গন্তব্য অঞ্চলগুলো মূল্যস্ফীতির প্রতিঘাতের মুখে পড়েছে। সেখানে ভোক্তাদের চাহিদাও খুব বাড়ছে না। সে সমীকরণ থেকেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি চলতি বছরের তুলনায় না বাড়িয়ে ৮ শতাংশের ঘরে রাখা হচ্ছে। একই কারণে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৮ শতাংশে আনা হয়। টাকার অঙ্কে ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) মার্কিন ডলার কাটছাঁট করা হয়েছে।
সরকারের আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিয়ম হার’ সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে এসব লক্ষ্যমাত্রার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা ধরেই নতুন বাজেট প্রণয়ন হচ্ছে। প্রতিবছর বাজেটে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ঘোষণা দেওয়া হয়। এটি চূড়ান্ত করতে সম্প্রতি পর্যালোচনা করেছে অর্থ বিভাগ। পাশাপাশি চলমান লক্ষ্যমাত্রার কতটুকু অর্জন সম্ভব সেটিও বিশ্লেষণ করা হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার রফতানি আয়ের যে টার্গেট নির্ধারণ ছিল তা কমিয়ে ৬ হাজার কোটি ডলারে আনা হয়েছে। বৈঠকে রফতানি আয় নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। তিনি বলেন, রফতানি যেহেতু আমদানি নির্ভর, তাই মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যেন রফতানি বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
আগামী অর্থবছরের রফতানির প্রবৃদ্ধি অর্জনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ওই বৈঠকে অর্থ সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেছেন, গত জুলাই থেকে মার্চ এই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তবে রফতানি পণ্যের গন্তব্য দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি হ্রাস এবং আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধির কারণে এই অর্থবছরের অবশিষ্ট সময়ে এ খাত থেকে আয়ের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে সুদহার না বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। দেশেও ইতোমধ্যে ঋণের সুদহার বেড়েছে। এতে আর্থিক ঘাটতি কমে রির্জাভ বাড়বে এবং মধ্য মেয়াদে রফতানিও বাড়বে।
এদিকে পণ্য রফতানি অঞ্চলগুলোতে আগামী দুই অর্থবছর অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হচ্ছে না এমন পূর্বাভাস দিয়েছে ইকোনমিক ফোরাম। সেটিকে মাথায় রেখে দেশের পণ্য রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৬ হাজার ৪৮০ কোটি ডলার নির্ধারণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরের জন্য আয় ৭ হাজার ১২৮ কোটি এবং ৭ হাজার ৮৪১ কোটি ডলার চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই দুই অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের ঘরে রাখা হয়েছে। আর না বাড়লে এ খাত থেকে মার্কিন ডলারের আয়ও বেশি হবে না। কিন্তু বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ এক ধরনের চাপের মধ্যে আছে। আগামীতে রির্জাভ বাড়াতে হলে রফতানি আয় তার অন্যতম উপকরণ। ফলে রির্জাভ বাড়ানো নিয়ে একটি দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।
এদিকে আয় বাড়াতে পণ্যের রফতানি বহুমুখীকরণ এবং বাজার সম্প্রসারণে সম্ভাবনাময় খাতগুলোর তালিকা তৈরির তাগিদ দিয়েছেন শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি মো. আমিন হেলালী বলেছেন, সক্ষম খাতগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বাজারে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, দেশের রফতানির মোট ৭৬ শতাংশ যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ ১২টি দেশে। সম্প্রতি বাংলাদেশি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি প্রবৃদ্ধি ২৩ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে ১৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ নেগেটিভ হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাসে দেখা গেছে, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং আগামী বছর কমে ৫ দশমিক ১ শতাংশ হবে। এশিয়া অঞ্চলে রফতানির ২০২৪ ও ২০২৫ সালে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হবে। তবে ইউরোপ অঞ্চলে কিছুটা বাড়বে এমন আভাস দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো রফতানি আয়ের একটি লক্ষ্যমাত্রা সরকারকে ঠিক করে দেয়। এখন রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসছে তৈরি পোশাক এবং বাকিটা আসছে অন্যান্য পণ্য থেকে। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রফতানির অর্ডার বিশ্লেষণ করেই এই ভিত্তি তৈরি করেছে। বিশ্বপরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে অনেক দেশে এখনো মন্দাভাব আছে। আমাদের রফতানি পণ্যের চাহিদা সেভাবে বাড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
এদিকে রফতানি বাড়াতে ২০২৪-২০২৭ এই ৩ বছরের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সরকার। সেখানে এই সময়ে আয় ১১ হাজার কোটি (১১ বিলিয়ন) ডলারে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু রফতানি অঞ্চলগুলোর পরিস্থিতি বিবেচনায় এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে নানা কারণে আগামীতে রফতানি আয় কমতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ব্যাংক ঋণে সুদহার আগের ৬-৭ থেকে বেড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ হয়েছে। লোহিত সাগরে জাহাজে জলদস্যুদের হামলার কারণে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় ইউরোপের কিছু রুটে পণ্য পরিবহণে সময় ১০-১৫ দিন বেড়েছে। এতে ব্যয় প্রায় ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্প কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ পরিবহণ খরচ বেড়েছে। এছাড়া ব্যবসা করার ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে সর্বস্তরে বেতন বৃদ্ধির ব্যয় মেটাতে ও গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিসহ অন্যান্য কারণে উৎপাদন খরচ ২৭ শতাংশ বেড়েছে।
বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, নানা ব্যয়ের তুলনায় রফতানি পণ্যের দাম তেমন বাড়েনি, অনেক ক্ষেত্রে ক্রেতারা তাদের ক্রয় মূল্য কমিয়েছে। এমতাবস্থায় বহুমুখী খাতের বিদ্যমান রফতানি বাজারের শেয়ার রক্ষা ও সম্প্রসারণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সহায়তা ব্যবস্থাকে জোরদার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, পণ্য রফতানির লিড টাইম জটিলতা এবং মূল্য কম দেওয়ায় অনেক অর্ডার ছুটে যাচ্ছে। এরসঙ্গে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধান না হলে রফতানি বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতার অবনতি ঘটাবে এবং একটি উচ্চ সম্ভাবনাময় সেক্টরের বৃদ্ধিকে মন্থর করতে পারে, যা স্বল্পোন্নত দেশ হতে টেকসই উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা রফতানি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৯৮ মিলিয়ন ডলার, যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ৭ শতাংশ কম। একই সময়ে শুধু চামড়াজাত জুতা রপ্তানি বিগত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ২৬ শতাংশ কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১০ মাসে সরকারের চামড়াজাত শিল্পের কৌশলগত রফতানি লক্ষ্য থেকে প্রায় ২২ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে। ●
অকা/বা/সৈই/সকাল/২৩ মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 years আগে

