অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রমে দেশের ব্যাংকগুলোর ব্যয় গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ৬১টি তফসিলি ব্যাংক মিলে সিএসআরে ব্যয় করেছে মাত্র ১৫০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। অথচ এর আগের ছয় মাসে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ছয় মাসে ব্যয় অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে।
এই ধস নামার আগে সর্বশেষ ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকগুলোর সিএসআর ব্যয় এত কম হয়েছিল—তখন ব্যয় ছিল ২৫৪ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে এবার প্রায় ১০৪ কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। এ ধারা চলমান থাকলে ব্যাংক খাতের সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের মানসিকতা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে সিএসআরে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২৯৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৪ কোটি টাকা, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুনে ব্যয় ছিল ৩০৯ কোটি টাকা এবং জুলাই-ডিসেম্বরে ৩০৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুনে ব্যয় নেমে আসে মাত্র ১৫০ কোটিতে। অর্থাৎ ২০২২ সালে রেকর্ড উচ্চতার পর থেকে সিএসআর ব্যয়ে ধারাবাহিক নিম্নগতি চলছে।
ব্যাংকারদের মতে, সিএসআরের ব্যয়ে হঠাৎ পতনের পেছনে মূল কারণ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সরকারের পরিবর্তন। রাজনৈতিক সরকারের সময়ে অনেক সময় ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি কিংবা প্রভাবশালীর অনুরোধে সিএসআরের বাজেট থেকে অর্থ দিতে হতো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা সরাসরি অনুদানের নামে এই অর্থ খরচ হতো, যা অনেক সময় প্রকৃত সামাজিক দায়বদ্ধতার বাইরে চলে যেত। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার পরিবর্তনের পর সেই চাপ কমে গেছে। এখন ব্যাংকগুলো বাইরের চাপ ছাড়াই নিজস্ব বিবেচনায় ব্যয় করছে। এর ফলে ব্যয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আগে সিএসআরের বাজেট ব্যবহার হতো রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইচ্ছা অনুযায়ী। কোথায় কত খরচ হবে—তা নির্ধারণ হতো বাইরে থেকে। এখন আর সে ধরনের চাপ নেই। ফলে ব্যাংকগুলো নিজেদের হিসাব-নিকাশ করে ব্যয় করছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতি ব্যাংককে নিট মুনাফার একটি অংশ সিএসআরে ব্যয় করতে হয়। এর মধ্যে শিক্ষা খাতে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ৩০ শতাংশ, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন খাতে ২০ শতাংশ এবং বাকি ২০ শতাংশ অন্যান্য খাতে খরচ করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ব্যাংকগুলো এই নির্দেশনা পুরোপুরি মানছে না।
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ৫৫ শতাংশ বা ৮৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ‘অন্যান্য’ খাতে। শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়েছে ২২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বা ৩৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়েছে ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ বা ২৮ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ বা ৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ থেকে বোঝা যায়, সিএসআরের মূল লক্ষ্য—শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উন্নয়ন—বরাবরের মতোই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
আলোচিত সময়কালে ১৩টি ব্যাংক কোনো ধরনের সিএসআর ব্যয়ই করেনি। এসব ব্যাংক হলো—জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, এসবিএসসি, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সিএসআরের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হলে সিএসআরের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। তাদের মতে, এখন যেহেতু রাজনৈতিক চাপ কমে গেছে, ব্যাংকগুলোর উচিত এই সুযোগে সিএসআরকে প্রকৃত অর্থে সামাজিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মতো খাতে যথাযথভাবে বিনিয়োগ করা হলে এর সুফল দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি ও সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 17 hours আগে