অর্থকাগজ প্রতিবেদন
ই-কমার্স, বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় একটি খাত, যা কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যকে সহজ করছে না, বরং কর্মসংস্থানেরও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে তরুণ উদ্যোক্তার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, সেখানে ই-কমার্স এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার এই অনলাইন বাজার ছোট-বড় প্রায় ৫ লাখ উদ্যোক্তাকে যুক্ত করেছে, যাদের অধিকাংশই নিজস্ব দোকান ছাড়াই অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করেন। এই খাত দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন চালিকা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিকে কাঠামোবদ্ধ করতে এবং শহরের অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার ওপর প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত চাপ কমাতে সক্ষম।

তবে সম্প্রতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ই-কমার্স খাতের ওপর আরোপিত বর্ধিত ভ্যাট নিয়ে উদ্যোক্তা মহলে দেখা দিয়েছে গভীর উদ্বেগ ও হতাশা। ই-কমার্স উদ্যোক্তারা আশা করেছিলেন যে, এই বাজেটে ইন্টারনেট খরচ কমবে, যা তাদের ব্যবসাকে আরও গতিশীল করবে। কারণ, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেটই এই খাতের মূল ভিত্তি। কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশার পরিবর্তে এসেছে এক নতুন চাপ। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রস্তাবিত বাজেটে অনলাইনে পণ্য বিক্রির কমিশনের ওপর ভ্যাট তিন গুণ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন। এই বর্ধিত ভ্যাট ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে যেখানে ১০০ টাকা আয়ের ওপর ৫ টাকা ভ্যাট দিতে হতো, এখন দিতে হবে ১৫ টাকা। এই বাড়তি চাপ অনেকেই পণ্যের দামে প্রতিফলিত করবেন, যার বোঝা শেষ পর্যন্ত সাধারণ ক্রেতাদের ওপর পড়বে। এটি একদিকে যেমন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে, তেমনি অন্যদিকে অনলাইন কেনাকাটার প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহও কমিয়ে দিতে পারে।
বিশ্বের যেসব দেশ ই-কমার্সে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে, যেমন চীন ও ইন্দোনেশিয়া, তারা মাথাপিছু ৭০ থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে। অথচ বাংলাদেশে এই বিনিয়োগ ৩ ডলারেরও কম। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে করের বোঝা চাপানো বিনিয়োগের পরিবেশকে আরও প্রতিকূল করে তুলবে। বর্ধিত ভ্যাটের কারণে বিনিয়োগ কমলে গ্রাহকদের জন্য বাড়তি সুবিধা ও মূল্যছাড় দেওয়ার সুযোগও সীমিত হয়ে পড়বে। এটি ই-কমার্স খাতের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো বিক্রেতাদের কাছ থেকে যে কমিশন নেয়, তার ওপর ভ্যাট বাড়ালে তাদের সেবার খরচও বাড়বে, যা সরাসরি পণ্যের দামে প্রতিফলিত হবে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকের বেশি পরিবার এখনো ইন্টারনেট ব্যবহার করছে না; গত বছরের শেষে মাত্র ৫২.৪ শতাংশ পরিবার ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। ই-কমার্স খাতের বিকাশের জন্য সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেট অপরিহার্য। যখন দেশের অর্ধেক জনগণ এখনো ইন্টারনেটের আওতায় আসেনি, তখন ই-কমার্সের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি না করে বরং খাতটিকে আরও সহায়তা দেওয়ার সময় এখনই। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই খাত এখনো তার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এখনই বাড়তি কর আরোপ না করে বরং আরও কয়েক বছর সময় দিলে তা আরও  বিস্তৃত হতে পারত। কর্মসংস্থানের দিক থেকেও এই খাত গত কয়েক বছরে দ্বিগুণ অবদান রেখেছে এবং এর অধিকাংশ উদ্যোক্তাই প্রান্তিক পর্যায়ের। অতিরিক্ত ভ্যাট তাদের ব্যবসা পরিচালনাকে কঠিন করে তুলবে এবং সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর লক্ষ্য পূরণে উল্টো প্রভাব ফেলতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, ই-কমার্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি অপার সম্ভাবনাময় খাত। এই খাতকে আরও গতিশীল করতে এবং এর পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকারের উচিত বর্তমান পরিস্থিতিতে বর্ধিত ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা। বরং, সহজলভ্য ইন্টারনেট ও নীতিগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এই খাতকে আরও শক্তিশালী করা গেলে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও বড় অবদান রাখতে পারবে।
অকা/ইক/ই/সকাল/১৪ জুন, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 4 months আগে

Leave A Reply

Exit mobile version