তারেক আবেদীন ●
নিজের পাতা ফাঁদে আটকে যাচ্ছেন সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর প্রাক্তন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (চঃ দাঃ) মীর রাশেদ বিন আমান। নিজের শ্বশুরকে ফাঁসাতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) দেয়া তথ্য প্রমাণে নিজেই এখন দুদকের মামলায় আসামী হয়েছেন মীর রাশেদ বিন আমান ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান নূর-ই-হাফজা। এদিকে দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) একই মামলায় অভিযুক্ত সোনালী লাইফের আরেক প্রাক্তন চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, তাঁর স্ত্রী ফজলুতুন নেছা, ছেলে মোস্তফা কামরুস সোবহান, বড় মেয়ে ফৌজিয়া কামরুল তানিয়া, ছোট মেয়ে তাসনিয়া কামরুন আনিকা, পুত্রবধূ সাফিয়া সোবহান চৌধুরী দুদক আতঙ্কে ভুগছেন। খবর একাধিক সূত্রের।
দুদকের মামলার আসামী হিসেবে যুক্ত হতে পারেন পরিচালক শেখ মোহাম্মদ ডানিয়েল, প্রতিষ্ঠাতা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) অজিত চন্দ্র আইচের ভাগিনী সুমি সেন, ভাগিনী জামাতা সুজন তালুকদার, ভাইপো রাজেশ আইচ ও হিসাব কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন মজুমদার। দুর্নীতি ও অনিয়মে অভিযুক্ত শেষোক্ত ৪ জন কর্মকর্তা বর্তমানে কোম্পানিতে নেই। অপরদিকে অজিত চন্দ্র আইচ (প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা) ৭ জুলাই অপ্রীতিকর এক ঘটনায় কোম্পানির বিক্ষুদ্ধ কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের তোপের মুখে পড়ে কোম্পানির প্রধান অফিস ত্যাগ করেন। বর্তমানে তিনি ১ মাসের ছুটিতে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, প্রাক্তন চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস তার বড় জামাতা মীর রাশেদ বিন আমানকে প্রতারণা ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে রাজধানীর মালিবাগ চেীধুরীপাড়াস্থ কোম্পানির বর্তমান বহুতল ভবন বিক্রির নাম করে সোনালী লাইফের তহবিল থেকে ৪০০ কোটি টাকার ওপরে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা যায়। সে টাকা দিয়ে ড্রাগন সোয়েটারের নামে থাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু ইম্পেরিয়াল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের নামে আরও ১৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেবার চেষ্টাকালে প্রাক্তন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (চঃ দাঃ) মীর রাশেদ বিন আমান বেকে বসেন। কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান মীর রাশেদ বিন আমানের স্ত্রী ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া পিতা মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের অনিয়ম ও দুর্নীতির কাজে প্রভাব বিস্তার করায় স্বামী মীর রাশেদ বিন আমানের সঙ্গে তানিয়ার দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। গৃহবিবাদ শুরু হয়। স্বামীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য শুরু করেন স্ত্রী। বিবাদের সময় তানিয়া স্বামীকে বলেন, আমার আব্বার চাকর তুমি! আব্বার টাকায় বাহাদুরি করো। কি আছে তোমার? এমন পরিস্থিতিতে স্বামী-স্ত্রীর (রাশেদ-তানিয়া) মধ্যে সম্পর্কের অবনতি চরমে পৌছে। এ অবস্থায় মীর রাশেদ বিন আমান কোম্পানির মানব সম্পদ কর্মকর্তা সুশ্রী ফাতেমা তামান্না সুইটিকে (বর্তমানে সাবেক) গোপনে বিয়ে করলে রাশেদ ও তানিয়ার কলহ চরম আকার ধারন করে। গত ৫ জানুয়ারি প্রথম স্ত্রী ফৌজিয়া কামরুন তানিয়াকে মীর রাশেদ বিন আমান তালাক দেন। একই সঙ্গে তিনি (রাশেদ) নিজেও কোম্পানির তহবিল থেকে ২০০ কোটি টাকা সরিয়ে নেন। অভিযোগ রয়েছে রাশেদের এই কাজে সহযোগিতার জন্য কোম্পানির কর্মকর্তা সুমি সেন, সুজন তালুকদার, রাজেশ আইচ, বোরহান উদ্দিন মজুমদার ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান নূর-ই-হাফজা উপহারস্বরূপ পান ৫০ কোটি টাকার ওপরে। এমনিতেই মীর রাশেদ বিন আমান দুশ্চরিত্র, লোভী ও দাম্ভিক স্বভাবের; তার ওপর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সংস্পর্শে থেকে নিজের আখের গোছানো, দাম্পত্য কলহে অস্থিরতা ও শ্বশুর মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের চাপ সামলাতে না পেরে শ্বশুর কর্তৃক কোম্পানির তহবিল তসরুপের সকল দালালিক প্রমাণাদি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) শাখায় গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর হস্তান্তর করেন। সেই ধারাবাহিকতায় বিএফআইইউ সোনালী লাইফের সফটওয়ার পার্টনার মীর রাশেদ বিন আমানের মালিকানাধীন ড্রাগন ইনফরমেশন টেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেড (ডিআইটিসিএল) এ হানা দিয়ে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসসহ সকলের বিরুদ্ধে ১৮৭ কোটি টাকার তহবিল তছরূপ ও মানি লন্ডারিংয়ের সত্যতা খুঁজে পায়। একই সঙ্গে কোম্পানির তহবিল থেকে মীর রাশেদ বিন আমান অস্ট্রেলিয়ায় ৭০ কোটি পাচার করেছেন তার প্রমাণ বিএফআইইউর নজরে আসে। সব তথ্য প্রমাণাদি বিচার বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট অভিযুক্তদের নামে মামলা রুজু করতে অতি সম্প্রতি তথ্য ও উপাত্ত দুদকে প্রেরণ করে।
উল্লেখ্য, বিএফআইইউ এর তদন্তকালে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস তার স্বপক্ষে যে সকল প্রমাণপত্র দাখিল করেছিলেন, সে সকল নথিপত্রের অধিকাংশ তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি এবং সোনালী লাইফের হিসাব বহিতে তার কোন অস্তিত্ব না থাকায় নকল নথিপত্ররের কারণে বিএফআইইউ তা আমলে নেয়নি। একই কারণে আগামীতে সকল আইনি লড়াইয়ে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস হেরে যেতে পারেন বলে মনে হচ্ছে। তবে এতে মীর রাশেদ বিন আমানেরও অপকর্ম থেকে পরিত্রাণের কোন সুযোগ নেই। কারণ, শ্বশুর জামাই দুজনই দুদকের নিশ্চিত শাস্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন!
সূত্র আরও জানায়, ২৯ জুলাই মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস তার সকল অপকর্মের পরামর্শক রূপালী ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর উপদেষ্টা অভিজ্ঞ ও মেধাবী পি কে রায় এফসিএ, এফসিএসকে নিয়ে মহানগরীর রাজউক এভিনিউস্থ রূপালী ভবনের পর্ষদ কক্ষে দিনভর বৈঠক করেছেন। সোনালীর লাইফ ও রূপালী ইনস্যুরেন্সের অধিকাংশ পরিচালক হচ্ছেন মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের পরিবার সদস্যগণ। লাইফ ও নন লাইফ এই দুটি কোম্পানির আলোচনা, পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত এবং সংকটের সমাধান নিয়ে দেন-দরবার এখন রূপালী ভবনেই হচ্ছে বলে জানা গেছে। পি কে রায়ের স্ত্রী মায়া রাণী রায় সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর একজন পরিচালক। সহধর্মিণী মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ পি কে রায় সোনালী লাইফে বিনিয়োগকৃত অর্থের মায়ায় দিনের বেশির ভাগ সময় শশব্যস্ত থাকছেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে রূপালী ইনস্যুরেন্সে যোগ্যতায় প্রধান নির্বাহী থেকে বর্তমানে উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত পি কে রায় কিভাবে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের পরিবারকে মহাসংকট থেকে বাঁচাবেন সে ব্যাপারে তিনি মরিয়া! জ্ঞানবান পি কে রায় হালে দুদুক আইন নিয়েও পড়াশোনা করছেন বলে জানা গেছে। দেশের শেয়ার বাজারে তালিকভুক্ত বীমা খাতের কোম্পানি সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ও তার পরিবারের ৮ জন সদস্যের বিরুদ্ধে ১৮৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অতি সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতারের আতঙ্কে ভুগছেন তারা। এছাড়াও অপকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেই দুদকের মামলার ভয়ে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন।
দেশের চতুর্থ প্রজন্মের জীবন বীমা কোম্পানি সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড ২০১৩ সালের ১ আগস্ট প্রতিষ্ঠা লাভ করে ব্যবসায়ে ব্যাপক সাফল্য পায়। আজ কোম্পানিটি এক যুগে পা রাখলো। অথচ সোনালী লাইফের সোনালী সুদিন নষ্ট হয়ে গেছে মালিকপক্ষের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে। সৎ ও পরিশ্রমি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চোখে মুখে দেখা যাচ্ছে অনিশ্চয়তা আর হতাশা। মাঠ কর্মকর্তা ও কর্মীদের মধ্যে চলছে হাহাকার! আর এ অবস্থায় বীমা গ্রাহকরা পড়েছেন বেকায়দায়। সংকটে নিমজ্জিত সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর মন্দ প্রভাবে কোম্পানিটির ব্যবসা দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। ●
অকা/বীখা/বিপ্র/সকাল, ১ আগস্ট, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 11 months আগে