অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ২৪টি কোম্পানির শেয়ারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং আমারস্টক ডটকমের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য বলছে, এসব কোম্পানির শেয়ারের বড় অংশ এখন উদ্যোক্তা পরিচালক, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে। এতে বাজারে শেয়ারের ফ্রি ফ্লোট বা লেনদেনযোগ্য অংশ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, যা তরলতা ও স্বচ্ছতা হ্রাসের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারধারিতার হার কমে যাওয়ার কারণে বাজারে শেয়ারের সরবরাহ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এর ফলে বাজারে দরবৃদ্ধি বা পতনের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ওঠানামা দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে দর নিয়ন্ত্রণে বড় বিনিয়োগকারী বা উদ্যোক্তাদের একক প্রভাব তৈরি হয়, যা বাজারের স্বাভাবিক গতিপথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। একইসঙ্গে এতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও আগ্রহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
তালিকাভুক্ত এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে ব্যাংক এশিয়া, বাটা সু, ব্র্যাক ব্যাংক, বিএটিবিসি, বার্জার পেইন্টস, বিএসআরএম স্টিল, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস, ডেসকো, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, এনভয় টেক্সটাইল, গ্রামীণ ফোন, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), ইসলামী ব্যাংক, যমুনা অয়েল, ম্যারিকো বাংলাদেশ, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, এমজেএল বাংলাদেশ, পাওয়ার গ্রিড, রেনেটা, রেকিট বেনকিজার, রবি আজিয়াটা, রূপালী ব্যাংক, ইউনিলিভার কনজুমার কেয়ার এবং ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।
উদাহরণস্বরূপ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক কোম্পানি, যার মোট শেয়ার সংখ্যা ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮৮০টি। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে মাত্র ০.৭৩ শতাংশ শেয়ার। বিপরীতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের দখলে রয়েছে ৯৫ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৪.০৭ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ০.২০ শতাংশ শেয়ার।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানির (বিএটিবিসি) শেয়ারের সংখ্যা ৫৪ কোটি। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ৮.১৫ শতাংশ, উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে ৭২.৯১ শতাংশ, সরকারের কাছে ০.৬৪ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ১৪.১১ শতাংশ এবং বিদেশিদের কাছে ৪.১৯ শতাংশ।
বাটা সু কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা ১ কোটি ৩৬ লাখ ৮০ হাজার, যার মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৯.৪৫ শতাংশ। উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে ৭০ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ১৯.৩৪ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ১.২১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
গ্রামীণ ফোন, দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল অপারেটর হিসেবে পরিচিত হলেও, এর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে মাত্র ২.৫৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। উদ্যোক্তাদের কাছে রয়েছে ৯০ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৬.৫১ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ০.৯৬ শতাংশ।
আইসিবি-এর মোট শেয়ার ৮৬ কোটি ৭২ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬১টি। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে মাত্র ২.১৭ শতাংশ। উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৬৯.২০ শতাংশ, সরকারের কাছে ২৭ শতাংশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ১.৬৩ শতাংশ শেয়ার।
রবি আজিয়াটা, যার মোট শেয়ার সংখ্যা ৫২৩ কোটি ৭৯ লাখ, সেখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মালিকানা মাত্র ৭.৯৭ শতাংশ। ৯০ শতাংশ রয়েছে উদ্যোক্তাদের দখলে এবং বাকিটা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভক্ত।
ইউনিলিভার কনজুমার কেয়ার, দেশের অন্যতম বৃহৎ কনজ্যুমার ব্র্যান্ড, যার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশ মাত্র ৩.৫০ শতাংশ। এই কোম্পানির ৯২.৮০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে, ৩.৫৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এবং ০.১১ শতাংশ বিদেশিদের হাতে।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে বাজারে অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশীদারিত্ব কমে গেলে বাজারে দর নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগকারীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে ছোট বিনিয়োগকারীরা ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
তারা আরও বলেন, শেয়ারবাজারে একটি স্বাস্থ্যকর ও ভারসাম্যপূর্ণ বিনিয়োগ পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন নীতিগত সংস্কার, যেমন — উদ্যোক্তা ও প্রাতিষ্ঠানিকদের শেয়ার ধারণের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, ফ্রি ফ্লোট শেয়ারের ন্যূনতম হার বাধ্যতামূলক করা এবং পুঁজিবাজারে অধিকতর স্বচ্ছতা ও তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা।
সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কিছু কোম্পানিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মালিকানা ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং এটি পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণ বৈষম্যের একটি বড় ইঙ্গিত বহন করে। বাজারের ভারসাম্য, স্বচ্ছতা এবং আস্থার জন্য এ চিত্র পরিবর্তনের দাবি সময়ের প্রয়োজন। ●
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/২৯ জুন, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 weeks আগে