অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
শেয়ার বাজারের মিউচুয়াল ফান্ড খাত দীর্ঘদিন ধরে যে কাঠামোগত দুরবস্থার মধ্যে ছিল, তা এখন আরও স্পষ্ট ও গভীর সংকটে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে কোনো অর্থবহ রিটার্ন না পাওয়ায় ইউনিট হোল্ডারদের আস্থা ক্ষয়ে গেছে। এর ফলে প্রকাশ্যে এসেছে দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, অব্যবস্থাপনা এবং সম্পদ ব্যবস্থাপকদের ওপর ভরসার সংকট। যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলোতে মিউচুয়াল ফান্ড দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত, সেখানে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীরা পাচ্ছেন মূলধন ক্ষয়, সীমিত ডিভিডেন্ড এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তার বোঝা। দুর্বল রিটার্ন, নীতিগত ভুল ও জবাবদিহিতার অভাব—সব মিলিয়ে খাতটি তার নিরাপদ বিনিয়োগ পরিচয় হারিয়েছে।
মিউচুয়াল ফান্ড খাতের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা ক্লোজড-এন্ড ফান্ড এবং ৫ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা ওপেন-এন্ড ফান্ডে রয়েছে। তালিকাভুক্ত ৩৭টি ক্লোজড-এন্ড ফান্ডের মধ্যে ৩৫টি তাদের এনএভির নিচে এবং ৩৩টি ফেস ভ্যালুর নিচে লেনদেন হচ্ছে। ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে অধিকাংশ ফান্ডের দাম ৩০% থেকে ১৫০% পর্যন্ত কমেছে। বাজার মূলধন নেমে এসেছে মাত্র ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকায়। বছরের পর বছর ডিভিডেন্ড ঘোষণা সীমিত থাকায় বিনিয়োগকারীরা রিটার্নবিহীন পরিস্থিতিতে আটকে আছেন। ইউনিট হোল্ডাররা লোকসান গুনলেও অ্যাসেট ম্যানেজাররা ফি সংগ্রহ করে চলেছেন—এটি ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট খাত জিডিপির মাত্র ০.১৭%—যা প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। ভারতে এই হার ১৬.২%, ভিয়েতনামে ৬.৩% এবং পাকিস্তানে ১.৭%। বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণের হার মাত্র ১%, যেখানে মালয়েশিয়া ৯%, থাইল্যান্ড ৮%, ভিয়েতনাম ৬.৬% এবং ভারতে ২.১%। এই বিশাল ব্যবধান প্রমাণ করে যে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আস্থার ঘাটতি কতটা গভীর।
খাতটির অচলাবস্থার অন্যতম কারণ ভুল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত। একাধিক অ্যাসেট ম্যানেজার অতিরিক্ত দামে অ-তালিকাভুক্ত বা দুর্বল কোম্পানিতে বড় অঙ্কে বিনিয়োগ করেছে। উদাহরণ হিসেবে আরএসিই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের মাল্টি সিকিউরিটিজ, পদ্মা ব্যাংক ও রিজেন্ট স্পিনিং মিলসের বন্ডে বিনিয়োগ এবং এলআর গ্লোবালের এনার্জিপ্যাক প্রিমা, ইউনিকর্ন ইন্ডাস্ট্রিজ ও পদ্মা প্রিন্টার্সে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য। এসব বিনিয়োগ থেকে কার্যকর রিটার্ন আসেনি, অথচ তদারকির দায়িত্বে থাকা ট্রাস্টিরা কোনো হস্তক্ষেপ করেননি।
ইউএফএস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ও অ্যালায়েন্স ক্যাপিটালের বিরুদ্ধে তহবিল পাচারের অভিযোগ উঠলেও সেই অর্থ উদ্ধার সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশের ছোট বাজারে ৫৮টি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি থাকার ফলে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে—যেখানে ভারতের বিশাল বাজারেও কোম্পানির সংখ্যা ৪৪টি।
দীর্ঘমেয়াদি বাজার মন্দার প্রভাব পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করেছে। সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে ডিএসইর প্রধান সূচক ৮৬৩ পয়েন্ট কমেছে। ফান্ডগুলো উল্লেখযোগ্য অ-স্বীকৃত লোকসানে রয়েছে এবং ডিভিডেন্ড ঘোষণার আগে বড় অঙ্কের প্রভিশনিং করতে হচ্ছে, যা রিটার্ন বিতরণের সক্ষমতা সীমিত করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএসইসি ছয়টি এলআর গ্লোবাল-পরিচালিত ফান্ডের লেনদেন স্থগিত করেছে, পদ্মা প্রিন্টার্সের মাধ্যমে প্রায় ৬৯ কোটি টাকার অপব্যবহার শনাক্ত হওয়ায়।
১৩ নভেম্বর প্রবর্তিত ‘মিউচুয়াল ফান্ড রেগুলেশনস, ২০২৫’-এ নতুন ক্লোজড-এন্ড ফান্ড নিষিদ্ধ করা, বিদ্যমান ফান্ডের মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ বন্ধ এবং বাজারমূল্য ধরে রাখতে ব্যর্থ ফান্ডগুলোকে ওপেন-এন্ডে রূপান্তর বা অবসায়ন—এই নির্দেশনা দিয়েছে। যদিও এটি খাতে কিছু শৃঙ্খলা আনবে, তবে দীর্ঘমেয়াদি আস্থাহীনতা দূর করতে আরও গভীর সংস্কার প্রয়োজন।
বাংলাদেশের মিউচুয়াল ফান্ড খাতের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালে আইসিবির প্রথম ফান্ডের মাধ্যমে। চার দশক পেরিয়ে গেলেও খাতটি এখনো পরিপক্ব, স্বচ্ছ ও আস্থাভিত্তিক বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠতে পারেনি। অনিয়ম, দুর্বল দক্ষতা, অকার্যকর তদারকি এবং বিনিয়োগকারী-বান্ধব নীতির অভাবের কারণে খাতটি এখন পুনরুদ্ধারের দীর্ঘ ও কঠিন পথে দাঁড়িয়ে।
আস্থা পুনরুদ্ধার, স্বচ্ছ নিয়ন্ত্রণ, কার্যকর দায়বদ্ধতা, দক্ষ সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও মানসম্মত বিনিয়োগ কাঠামো ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়—এটাই এখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ●
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 5 days আগে

