অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের আলোচনায় রাজি হওয়ার ঘটনা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মোড় এনে দিতে পারে। এই চুক্তির বাস্তবায়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
যদি এই চুক্তি কার্যকর হয়, তবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য রফতানি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার লাভ করবে। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ বর্তমানেও উল্লেখযোগ্য, এবং শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেলে তা নিঃসন্দেহে বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। অংশীজনরা মনে করছেন, এটি বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের সত্যতা নিশ্চিত করে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বড় খবর। প্রক্রিয়াটি দ্রুত করতে যুক্তরাষ্ট্র এরমধ্যেই চুক্তির একটি খসড়া চেয়েছে।"
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক আরোপিত বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে। সেই বৈঠকে বাণিজ্য সচিবও উপস্থিত ছিলেন। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এফটিএ স্বাক্ষরের প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে, ইউএসটিআর কর্মকর্তারা তাতে সম্মতি জানান এবং বাংলাদেশের কাছে চুক্তির একটি খসড়া চান।
বাণিজ্য সচিব এই প্রসঙ্গে আরও বলেন, "ইতোপূর্বে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রকে এফটিএ স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখন তারা এতে আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু এবার তারা রাজি হয়েছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সংবাদ। আমরা নেগোসিয়েশন (আলোচনা) শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছি।" তিনি জানান, প্রস্তাবিত এফটিএ'র খসড়া তৈরির জন্য একটি ডেডিকেটেড কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১২ মে একটি আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির প্রধান দায়িত্ব হলো প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ)-এর খসড়া তৈরি করা। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ)-কে প্রধান করে গঠিত এই কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে খসড়া প্রণয়ন করে বাণিজ্য সচিবের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি এবং বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ রফতানি গন্তব্য। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট রফতানির ১৭.০৯ শতাংশ এবং তৈরি পোশাক রফতানির ১৮ শতাংশের বেশি যুক্তরাষ্ট্রে যায়। এছাড়াও, বাংলাদেশের মোট ওভেন পোশাকের প্রায় ২৬ শতাংশ, নিটওয়্যারের ১১.৭১ শতাংশ এবং হোম টেক্সটাইল পণ্যের ১৬.১২ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়।
তৈরি পোশাক খাতের (আরএমজি) ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, এই চুক্তির ফলে তাদের প্রধান প্রতিযোগী দেশ, যেমন ভিয়েতনাম ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা পাবে। উল্লেখ্য, ভিয়েতনাম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানিতে মাত্র ৭ শতাংশ শুল্কের সুবিধা পাচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশকে ১৫ শতাংশেরও বেশি শুল্ক দিতে হয়। ভিয়েতনাম এবং ভারতও ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব করেছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে তাদের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।"
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বর্তমান শুল্ক কাঠামোয় একটি বড় ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা পণ্যে গড় শুল্ক হার মাত্র ৬.১ শতাংশ। বাংলাদেশ মূলত যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাঁচা তুলা ও স্ক্র্যাপ লোহা আমদানি করে, যেগুলোর ওপর শুল্ক হার যথাক্রমে ০ শতাংশ ও ১ শতাংশ।
২০১৩ সালের আগে পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করত, তবে এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বর্তমানে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৫.৫০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে রফতানি হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এই পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নেয়। ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করে, যা ঢাকার অনুরোধের প্রেক্ষিতে বর্তমানে তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর প্রেসিডেন্টও আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ তুলা, স্ক্র্যাপ, সয়াবিন ও কৃষিপণ্য আমদানি করে, যার বেশিরভাগই শুল্কমুক্ত অথবা সামান্য শুল্কে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাই দেশটির সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর হলে বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।"
বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরে রাজি হলে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য খুবই ভালো খবর। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মেধাস্বত্ব অধিকার, শ্রম মানদণ্ড, পরিবেশগত বিধিমালা ও ব্যবসার সার্বিক পরিবেশ উন্নত করতে হবে।"
গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির পরিমাণ ছিল ৭.৬০ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশটিতে রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭.১৯ বিলিয়ন ডলার, যা এই সময়ে বাংলাদেশের মোট রফতানির ১৭.৮৭ শতাংশ। এর বিপরীতে, গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ২৮ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এর পরিমাণ ২২ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে গত ১৩ মে একটি স্টেকহোল্ডার সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রস্তাবিত পাল্টা শুল্ক এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি, এফটিএ স্বাক্ষরের কৌশল ও প্রক্রিয়া নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন যে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ যদি মোস্ট ফেভার্ড নেশন (এমএফএন) এর ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়, তবে ডব্লিউটিও'র সদস্য অন্যান্য দেশও একই সুবিধা পাবে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের আমদানি তেমন বাড়বে না।
এই প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের এফটিএ আলোচনা শুরুর একটি প্রস্তাব উঠে আসে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, এফটিএ স্বাক্ষর করে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিপরীতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রফতানি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায়ের প্রস্তাব করা হবে।
উক্ত সভায় ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)-এর প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের মাধ্যমে উভয় দেশের পণ্য রফতানিতে জিরো ট্যারিফ সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "যতদিন এফটিএ স্বাক্ষর না হবে, ততদিন বিদ্যমান টিকফা চুক্তির আওতায় শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রফতানি পণ্যের ওপর বিদ্যমান শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করা হবে।"
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ (এলডিসি গ্রাজুয়েশন) কে সামনে রেখে সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিলেও, জাপান ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আলোচনায় তেমন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। জাপানের সঙ্গে ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (ইপিএ) স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনা চলতি মাসেই টোকিওতে পঞ্চম রাউন্ড সম্পন্ন হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) স্বাক্ষরের জন্য চতুর্থ দফা আলোচনা হওয়ার পর প্রায় এক বছর ধরে আর কোনো অগ্রগতি নেই। মূলত উভয় দেশই পরস্পরের বাজারে তৈরি পোশাক রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দাবি করলেও কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি না হওয়ায় আলোচনা স্থবির হয়ে আছে। একইভাবে তৈরি পোশাক পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে রাজি না হওয়ায় শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য প্রথম দফার আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তবে সরকার পরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা) স্বাক্ষরের আলোচনা শুরুর বিষয়ে কোনো পক্ষেরই তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। চীনের সঙ্গে এফটিএ আলোচনা গত বছর শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনও শুরু হয়নি।
ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর চীনের নেতৃত্বাধীন রিজিওনাল কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসেপ) ও আসিয়ানে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করে বাংলাদেশ চিঠি দিলেও এখনও পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক সাড়া পাওয়া যায়নি। এছাড়াও, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সেপা স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা শুরু হওয়ার এই ইতিবাচক অগ্রগতি বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। তবে এই আলোচনা সফলভাবে সম্পন্ন করতে এবং বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে বিচক্ষণতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে। ●
অকা/তৈপোশি/ই/সকাল/১৮ মে,২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 months আগে