প্রণব মজুমদার ●
অন্তর্বতীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। সরকারের বয়স মাত্র ৫ দিন। দেশের অর্থনৈতিক মন্দ অবস্থা দীর্ঘ সময় ধরে। এর ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার করে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্পন্ন করার বড় দায়িত্ব পড়েছে নতুন সরকারের ওপর। কাজটি বেশ কঠিন! সময়সাপেক্ষও বটে।
২০২৪-২৫ সালের অর্থ বছর শুরু হয়েছে ১ জুলাই থেকে। দেশ অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। কোথায় অবস্থান করছে দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো? সূচকগুলো খুব হতাশার! বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং ২০২৩ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ি জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ, মাথাপিছু আয়, প্রবাসী আয়, রফতানি আয়, পণ্য আমদানি, বেসরকারি বিনিয়োগ, ব্যাংক খেলাপী ঋণ, শেয়ার বাজার ও মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অধিকাংশ সূচকের অবস্থাই নেতিবাচক! অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতকৃত সাময়িক হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে তা ছিল শতকরা ৬.০৩ হার। দেশের রিজার্ভ ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ছিল ৩১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পরের অর্থ বছরে তা নেমে দাঁড়ায় ২৭.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে! দেশের মাথাপিছু আয় ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বেড়েছে। পরিমাণ ২৭৮৪ মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে তা ছিল ২৭৪৯ মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন অবধি প্রবাসী আয় হয়েছে ২৩২৯ কোটি মার্কিন ডলার। যা আগের অর্থ বছরে ১৬৮ কোটি মার্কিন ডলার কম ছিল। ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত রফতানি আয় হয়েছে ৫১৫৪ কোটি মার্কিন ডলার। অথচ ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আয় হয় ৫৫৫৬ কোটি মার্কিন ডলার। গেলো বছরের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস অবধি দেশে পণ্য আমদানি হয় ৪ লাখ ৮৫ হাজার ১০ কোটি টাকার। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে তা বেশি ছিল। এ সময় পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৪৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। রাজস্ব আয় ও বেসরকারি বিনিয়োগে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের সাময়িক হিসাবে দেখা যায় ইতিবাচক প্রবণতা থাকলেও দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। চলতি বছরের মার্চ অবধি খেলাপী ঋণ বাড়ে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে খেলাপী ঋণের পরিমাণ বেড়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশে। দেশের শেয়ার বাজার ছিল বেশ মন্দা। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে দেশের প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল সূচক ডিএসইএক্স ১০০০ পয়েন্ট বা ১৬ শতাংশের বেশি কমে। অথচ ২০২৩ সালের ২ জুলাই অর্থ বছরের প্রথম কার্যদিবসে ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৬৩৪৩ পয়েন্টে। অর্থ বছরের শেষ দিন ৩০ জুন তা কমে দাঁড়ায় ৫৩২৮ পয়েন্টে।
খাদ্যপণ্যের উর্ধ্বগতির দামে দেশের মানুষের ছিল নাভিশ্বাস! ২০২৪ সালের এপ্রিলে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮১ শতাংশে।
বিগত দিনগুলোতে দেশের অর্থনীতি যে নাজুক অবস্থায় ছিল; তা উল্লেখিত তথ্য ও পরিসংখ্যানে পরিলক্ষিত হয়। এ অবন্থায় অর্থনীতিকে সন্তোষজনক অবস্থায় আনয়নে কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটা শ্বেতপত্র তৈরি করতে হবে। শ্বৈতপত্র তৈরি করলে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে। নতুন সরকার কোন অবস্থায় অর্থনীতিকে পেল, তার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন দরকার। শ্বেতপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি মূল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিক নির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক পথ তৈরি হবে। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তা গণতান্ত্রিক ভিত্তি দেবে। সরকার তা না করলে এ ব্যাপারে পেশাজীবী নাগরিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। শ্বেতপত্র তাই তৈরি করা জরুরি। শ্বেতপত্র তৈরি করতে হলে অবশ্যই সরকারকে একটি কাঠামো দিতে হবে। কাঠামোর সঙ্গে সরকারের আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান অবস্থানপত্র তৈরি করবে। যেমন এরিমধ্যে দায়দেনা পরিস্থিতি নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্র রয়েছে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অবস্থানপত্রও দরকার। পাশাপাশি অংশীজনের মতামত নিতে হবে। বেসরকারি খাত, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং উন্নয়ন সহযোগীদের যুক্ত করতে হবে। ব্যক্তি খাতের বড় ও মাঝারিদের পাশাপাশি ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মতামতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে শ্বেতপত্র তৈরিতে এক মাসের বেশি সময় নেওয়া ঠিক হবে না।
অনেক কিছুই নির্ভর করবে অস্থায়ী সরকারের মেয়াদকালের ওপর। মেয়াদকাল যাই থাকুক না কেন, অল্প সময়ের মধ্যে একটি ডাটা কমিশন করার পরামর্শ দেই। তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে যেসব ব্যত্যয় হয়েছে এবং ঘাটতি আছে, সেই জায়গাটা পরিষ্কার করতে হবে। তথ্যের উৎপাদক, ব্যবহারকারী এবং মূল্যায়নকারী– এই তিন পক্ষকে এর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। সরকারি তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রয়োজন।
ব্যাংকিং এবং জ্বালানি খাত অর্থনীতির ফুসফুসের মতো কাজ করে। ব্যাংকিং কমিশন তৈরি করা দরকার। কিন্তু এর পরিধি কী হবে তা সরকারের সময়কাল ও সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করবে। যে সময় পর্যন্ত সরকার থাকবে, তার মধ্যে ব্যাংকিং খাতের রোগ নির্ণয় করার সময় পাবে। একটি ব্যাংক কমিশন হওয়া উচিত। অতীতে অনেকেই তা বলে এসেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকসহ সকল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে তথ্য-উপাত্তের সঠিক যাচাই করা হবে এর প্রথম কাজ। খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণও করা হবে বড় কাজ। প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন পর্যাপ্ততার মতো বিষয়গুলোকে স্বচ্ছতার সঙ্গে যাচাই করতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে মালিকদের প্রতিনিধিত্ব এবং সময়কাল পর্যালোচনা করে বর্তমানের শিথিল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আমানতকারীদের স্বার্থ বিঘ্নিত না করে একটি বাস্তবসম্মত নীতি প্রণয়ন করতে হবে। ঋণ অবলোপনের নিয়ম পর্যালোচনা করতে হবে। ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ হতে হবে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে। যেসব শক্তিশালী শিল্প গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছে, তাদের মালিকানার প্রশ্নটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সুরাহা করা প্রয়োজন। যদিও তা রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়। করপোরেট সুশাসনে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, যার সঙ্গে মালিকানা ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। অভিজ্ঞ, বিজ্ঞ ও পেশাদারদের সমন্বয়ে শক্তিশালী একটি কমিটি করা যেতে পারে, যারা ব্যাংকে পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী নিয়োগের অনুমোদন দেবে। এ ধরনের কমিটি দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের মতো হতে পারে। ফলে রাজনৈতিক নিয়োগের চর্চা বন্ধ হবে।
জ্বালানি খাতের জন্য একটা টাস্কফোর্স চাই। ২৩ থেকে ২৪ হাজার মেগাওয়াটের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট কেন উৎপাদন করতে হচ্ছে এবং একই সঙ্গে আমদানি করতে হচ্ছে - টাস্কফোর্স থেকে তার ওপর প্রাথমিক একটা প্রতিবেদন দেওয়া যেতে পারে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও দায়মুক্তির বিষয়গুলোও সেখানে যোগ হবে।
খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সরকারের খোলা বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা যুৎসই এবং টেকসইভাবে অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারিভাবে বাজার নিয়মিত তদারকির পাশাপাশি ন্যায্য মূল্যে পণ্য সরবরাহ করা যেতে পারে। অতি মুনাফাখোর গোষ্ঠীবদ্ধ ব্যবসায়িদের লোভ ও দাপট কমাতে রেশনিং প্রথা পুনরায় চালুর ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমানের খাদ্য মজুত পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং আমন সংগ্রহ অভিযান কার্যকরের পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে হবে। খাদ্য উৎপাদনের সঠিক তথ্য প্রকাশ যেমন করতে হবে তেমনি ঘাটতি থাকলে আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। ভোক্তার কাছে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় যে কোন ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। এতে করে মূল্যস্ফীতি অনেকটা কমানো সম্ভব হবে।
সরকারের দায়দেনা পরিস্থিতির হালনাগাদ মূল্যায়ন করতে হবে। আগের সরকার যেসব চুক্তি করেছে, কোনো অবস্থাতেই এসব অর্থায়ন আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি যাতে না হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংকসহ অন্যদের ঋণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে মনোযোগ থাকতে হবে। এদের অনেক টাকাই সামাজিক সুরক্ষার সঙ্গে জড়িত। কোনো অবস্থাতেই যাতে ভাতা বন্ধ না হয়, পরিধি যাতে সংকুচিত না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
নতুন সরকারের জন্য তিনটি জিনিস বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাহলো সামাজিক আকাঙ্ক্ষা, মাঠ পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতা ও নেতৃত্বের সক্ষমতা। বিষয়গুলো নতুন সরকার কী পারবে বা পারবে না তা সময় বলে দেবে। সরকারের সময়কাল তার কর্মপরিধি নির্দিষ্ট করবে। নতুন একটি সংবিধান রচনা করাও সরকারের বড় দায়িত্ব। যদি তা সম্ভব না হয় তা হলে সংবিধানের ৪ নীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ নিশ্চিত করতে হবে। কেননা দেশটা সকল ধর্মের ও জাতির।
অন্তর্বতীকালীন সরকারের কাছে সমগ্র জনগণের প্রত্যাশা অনেক। অতীতে অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অপশাসন ছিল বলেই ছাত্ররা রাজপথে নেমে এসেছিল। সরকারের পতন ঘটিয়েছে। আমার বিশ্বাস, নতুন সরকার ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় অবস্থানে নিতে সক্ষম হবে। ●
লেখক কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক
reporterpranab@gmail.com
অকা/নিখে/রাত/১২ আগস্ট, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 9 months আগে