অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●

বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দীর্ঘদিনের স্থবিরতা ও সংকট ব্যবস্থাপনার জটিলতার মধ্যে সমস্যাগ্রস্ত পাঁচ ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে গঠিত নতুন ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’-এর আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে একটি বিশেষ স্কিমের খসড়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই স্কিম কার্যকর হলে কয়েক ধাপে আমানতকারীরা তাদের টাকা তুলতে পারবেন—যা আস্থা সংকট কমানোর পাশাপাশি পুরো প্রক্রিয়াকে আইনগত ও আর্থিকভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখতে সাহায্য করবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

স্কিমের আওতায় প্রথম ধাপে যেসব গ্রাহকের হিসাবে দুই লাখ টাকা বা তার কম রয়েছে, তারা পুরো অর্থ একবারেই তুলতে পারবেন। আর যাদের হিসাবে দুই লাখ টাকার বেশি রয়েছে, তাদের জন্য রয়েছে ধাপে ধাপে উত্তোলন পদ্ধতি—প্রতি তিন মাসে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করে তোলার সুযোগ, যা নির্ধারিত হয়েছে দুই বছর পর্যন্ত। তবে ৬০ বছরের বেশি বয়সী গ্রাহক, কিংবা ক্যানসার বা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত আমানতকারীদের জন্য এই সীমাবদ্ধতা শিথিল রাখা হয়েছে; তারা প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো সময় যেকোনো পরিমাণ টাকা তুলতে পারবেন। অর্থাৎ ঝুঁকিপূর্ণ ও বিশেষ পরিস্থিতির গ্রাহকদের সুরক্ষায় বাড়তি নমনীয়তা রাখা হয়েছে।

এই বিশেষ স্কিমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে। গভর্নর আহসান এইচ. মানসুরের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে নতুন একীভূত ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া, চার ডেপুটি গভর্নর, পাঁচ সমস্যাগ্রস্ত ইসলামী ব্যাংকের প্রশাসক এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় উঠে আসে—যদিও নতুন ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়েছে, তবুও কার্যক্রম শুরু করতে এখনো বেশ কিছু জটিলতা রয়ে গেছে। নতুন ব্যাংকের ডাটাবেস তৈরি হয়নি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ হয়নি এবং বিভিন্ন আইনি দিক পুরোপুরি সমাধান হয়নি। ফলে ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে টাকা ফেরত দেওয়ার অবস্থায় নেই। তবুও গভর্নর নির্দেশ দিয়েছেন—ডিসেম্বরের মধ্যেই আমানত ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে, এমনকি তার জন্য আমানত বিমা তহবিল ব্যবহার করেও প্রথম ধাপের পেমেন্ট সম্পন্ন করতে হবে।

এই আলোচনায় আরও উঠে আসে স্কিম বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় শর্তাবলি। যেসব গ্রাহক সুবিধা নিতে চান, তাদের অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে খোলা বৈধ হিসাব থাকতে হবে। একজন গ্রাহকের এক ব্যাংকে একাধিক হিসাব থাকলেও তিনি একটি হিসাব থেকেই সুবিধা পাবেন। তবে পাঁচ ব্যাংকে পৃথক পৃথক হিসাব থাকলে প্রতিটি হিসাবের বিপরীতে টাকা তোলার সুযোগ থাকবে। যাদের ঋণ রয়েছে, তারা ঋণ সমন্বয় না করা পর্যন্ত স্কিমের আওতায় টাকা তুলতে পারবেন না—এটি আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আমানতকারীদের অপ্রয়োজনে টাকা না তুলতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য—একীভূত হওয়ার পর ব্যাংকটি মূলত নতুনভাবে শুরু করছে, আর বাস্তবিক অর্থে আমানতের জন্য তাৎক্ষণিক কোনো ঝুঁকি নেই। স্কিমের উদ্দেশ্য হলো আতঙ্ক না ছড়িয়ে ধাপে ধাপে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা এবং ব্যাংকিং খাতের চাপ কমানো, যাতে স্বাভাবিক লেনদেন সময়ের সঙ্গে স্থিতিশীল হয়।

এই পুরো সংকটের পেছনে রয়েছে ব্যাংক খাতের দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারি। গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কয়েকটি প্রভাবশালী গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে ডজনখানেক ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে যায়। এর ফলে এসব ইসলামী ব্যাংকের টেকসই তারল্য নষ্ট হয় এবং খেলাপি ঋণের চাপ দ্রুত বাড়তে থাকে। সংকট এতটাই জটিল হয়ে পড়ে যে শেষ পর্যন্ত পাঁচটি ব্যাংক—এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক—একীভূত করে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নতুন ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ২০ হাজার কোটি দেবে সরকার এবং বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা আসবে আমানতকারীদের শেয়ার থেকে। অনুমোদিত মূলধন ৪০ হাজার কোটি। বর্তমানে এসব ব্যাংকে ৭৫ লাখ আমানতকারীর মোট আমানত ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে ঋণ রয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা—যার বড় অংশ এখন খেলাপি। ফলে এই একীভূতকরণ কেবল প্রশাসনিক নয়; বরং আর্থিক স্থায়িত্বের জন্য এটি অত্যাবশ্যক পর্যায়ের পুনর্গঠন।

দেশজুড়ে এসব ব্যাংকের রয়েছে ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ৯৭৫টি এটিএম। একীভূত হওয়ার পর একই এলাকায় একাধিক শাখা থাকলে সেগুলো একীভূত করা হবে এবং পরিচালন ব্যয় কমাতে কর্মীদের বেতন–ভাতা ইতোমধ্যেই ২০ শতাংশ কমানো হয়েছে। নতুন ব্যাংকের কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে মতিঝিলের সেনা কল্যাণ ভবনে স্থাপন করা হচ্ছে। একটি চলতি হিসাবও খোলা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল শাখায়। পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং নতুন এমডি নিয়োগের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

এর আগে ৫ নভেম্বর প্রশাসক নিয়োগ ও ব্যাংকগুলোর শেয়ার শূন্য ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা একীভূত প্রক্রিয়ার আইনি ভিত্তি তৈরি করে। এখন বিশেষ স্কিম চালুর মাধ্যমে আমানতকারীদের টাকা ধাপে ধাপে ফেরত দেওয়া এবং ব্যাংকটির ধীরে ধীরে পূর্ণ সক্ষমতায় ফিরে আসার পথ খুলে দেওয়া হচ্ছে।
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/১০ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 8 hours আগে

Leave A Reply

Exit mobile version