প্রণব মজুমদার ●
সব কি চলছে ঠিকঠাক মতো? সীমিত আয়ের মানুষের অল্প চাওয়াগুলো কি পূরণ হচ্ছে? সামাজিক জীবনে তাঁদের কি সত্যিকারের আনন্দ বিদ্যমান? সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কি বৈষম্যের ব্যবধান কমেছে? কাউকে কুশল জিজ্ঞাসা করা হলে সোজা উত্তর- ভালো নেই! নেতিবাচক এই উত্তর অনেক দিন থেকেই লক্ষ্য করছি। ভোগবাদ, স্বার্থ, লোভ এবং হালুয়ারুটির ভাগাভাগি দৃশ্যমান! লোভীদের অন্যায্য চাহিদা দিনদিন বেড়ে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অনাচার! অস্থির যেন আমরা সবাই! বৈষম্য সংস্কৃতি আমাদের দেশটাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে? সীমিত আয়ের মানুষের কান্না কেউ শুনছে না! শাক-ভাতের সংসার চালাতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে তাঁদের দীর্ঘশ্বাস! কে দেখে তাদের চোখের জল? বিনিদ্র রাতের মানুষগুলোর অন্তর্মুখি রক্তক্ষরণ কে প্রতিরোধ করবে? সমাজ-সংসারে বৈষম্য দেখে দেখে সাধারণ মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষ কেউ কেউ বাঁচতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। সংসার চালাতে গিয়ে মানুষের ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ সীমিত রোজগার, অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা এবং মূল্যস্ফীতি।
নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদেরও দিনকাল আজ ভালো নেই। দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের জন্য সীমিত আয়ের মানুষগুলো সঞ্চয় ভেঙ্গে খাচ্ছে। পণ্যমূল্য এমন উচ্চতায় পৌছেছে যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় সাধারণ খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েই এদের নাভিশ্বাস! মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ প্রকৃতি হলো এরা না পারে ওপরে যেতে, না পারে নিচে নামতে। আত্ম সম্মানের ভয়ে এরা টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে পারে না। সৎ মানুষগুলো তাই চিন্তায় মনরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। আতঙ্কে অকালে ঝরে পড়ছে প্রাণ! কেউ কেউ নীরবে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে প্রবাসীর স্ত্রী রিনা আক্তার (৩১) কদিন আগে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সেপ্টেম্বরে গৃহের সিলিং ফ্যানে ফাঁস দিয়ে চলে গেলেন দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রথিতযশা একজন সাংবাদিক। স্বল্প আয়ের প্রতিভাবান মধ্যবয়সী এ সৎ সাংবাদিক সংসারে বর্ধিত খরচের যোগান ঠিকমতো দিতে পারছিলেন না।
কমাস আগে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় সায়মা বেগম (৩৫) তার মেয়ে ৯ বছরের ছাইমুনা এবং ৭ বছরের ছেলে তাওহীদকে নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঋণের চাপে তার এই আত্মহত্যা।
ঋণের জ্বালা সইতে না পেরে বছরখানেক আগে সিরাজুল ইসলাম (৫৫) নামের ঝিনাইদহের এক ব্যবসায়ী শেষমেশ বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। সুদের যন্ত্রণা তার হৃদয় কতটা ক্ষতবিক্ষত করেছে, তা ফুটে উঠেছে জীবননাশের আগে লিখে যাওয়া চিরকুটের অক্ষরে অক্ষরে।
সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন সৎ এক লেখক বন্ধু। কিডনী রোগে আক্রান্ত স্ত্রীকে অর্থাভাবে ফল কিনে খাওয়ানোর সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। কারণ হাতে বাড়তি অর্থ নেই তাঁর!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উচ্চ শিক্ষিত মধ্যবয়সী একজন বেসরকারি ফার্মের চাকরীজীবী আদাবরের ভাড়া বাসায় বসবাস করে আছেন। যা মাইনে পান তাতে কোন রকমে দিন অতিবাহিত হচ্ছিল তাঁর। খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের অংকে প্রতি মাসেই টান পড়ে। জমে গেছে বাসা ভাড়া কয়েক মাসের। নিয়মিত খরচ মিটানোর দুঃচিন্তা। চলতি বছর শেষে পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন ২ সন্তানের মেধাবী এ কর্মজীবী। কারণ বাড়তি উপার্জন নেই তার।
ঢাকা সিটি কলেজের বিপণন বিভাগের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আহসানুল হক (২১)। মুখে কাপড় বেঁধে রিকশা চালান কুমিল্লার তেলিকোনার এই তরুণ। রাজধানীর শাহজাহানপুর রেল কলোনী একটি সাবলেটে থাকেন তাঁরা। শহীদবাগ থেকে তাঁর রিকশায় চড়ে মতিঝিল আসছিলাম আজ। সম্মানের ভয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে প্যান্ডেল চাপছিল অতি কষ্টে। বলল, সংসারে ৫ সদস্যের খাবার জুটাতে কাঠমিস্ত্রি বাবার প্রাণান্তকর অবস্থা। পিতা বলেছেন, তাঁর পড়ার খরচ চালাতে পারবেন না। তাই সে ছাত্রাবস্থায়ই উপার্জনের পথে বেরিয়ে পড়েছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানসিক চাপ বাড়ছে। বাড়ছে ঋণের বোঝা। দ্রব্যমূল্য দিনে দিনে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এখন এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যেখানে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মানুষ। আর যাদের সঞ্চয় নেই, তারা ঋণ করছে। ফলে বাড়ছে মানুষের ওপর খরচের বাড়তি চাপ। এ অবস্থায় মহানগরের বস্তিবাসী, পোশাক শ্রমিক, গৃহকর্মী নয় শুধু; মধ্যবিত্তের মা-মেয়েরাও পেটের তাগিদে গৃহে, পার্লারে ও হোটেলগুলোতে অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়েছে।
তাহলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার কি কোন অধিকার নেই? রাজা-রাণী আসে আর যায় কিন্তু এদের কথা ভাবার মানুষ কোথায়? তেল মাথায় তেল দেয় ক্ষমতাবানরা। দিনে দিনে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষ নিঃস্ব ও দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষদের দুঃখগাথার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দিনবদলের সরকারের গভীরভাবে চিন্তার সময় এখনই। কেননা, কষ্টে থাকা সৎ মানুষেরাও ক্ষমতার শক্তি। ●
অকা/নিলে/সন্ধ্যা/২৭ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
লেখক কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক
reporterpranab@gmail.com
সর্বশেষ হালনাগাদ 7 months আগে