তারেক আবেদীন ●
দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড থেকে শেষ অবধি ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আবদুল মতিন ও তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে পরিচিত এবং বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগকৃত কোম্পানির উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক লুৎফুন নাহার আলোকে বিদায় নিতে হলো। অর্থাৎ হোমল্যান্ড থেকে মতিন আলো নিভে গেল! খবর নির্ভরযোগ্য সূত্রের।
কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) পদ থেকে মোহাম্মদ আবদুল মতিন অব্যাহতি দেন। কোম্পানি থেকে এক পত্রে (এইচএলআই/এইচও/প্রঃকাঃ/সিএস/দপ্তর/০০১১/২৫, তারিখ–১৩/০২/২০২৫) চেয়ারমান তাকে জানান, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত কোম্পানির ১৪৯তম পরিচালনা পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু কোম্পানির বৃহত্তর স্বার্থে ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ থেকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) পদ থেকে আপনাকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। একই তারিখ থেকে অপর এক পত্রে (এইচএলআইএইচও/প্রঃকাঃ/সিএস দপ্তর/০০৯/২০২৫, তারিখ – ১৩/০২/২০২৫) কোম্পানি সচিব ও প্রধান মানব সম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (বিপণন) লুৎফুন নাহার আলোকে চাকুরি হতে অব্যাহতি দেন। পত্রে বলা হয় তার সঙ্গে কেউ যেন আর্থিক লেনদেন ও যোগাযোগ না করে। আরেকটি পত্রে কোম্পানি সচিব ও প্রধান মানব সম্পদ কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার আলোর জায়গায় অর্থাৎ উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (বিপণন) পদে মো. জাকির হোসেন সরকারকে নিয়োগ দিয়েছেন। জাকির হোসেন সরকার এ পদে যোগদান করেছেন।
২৮ বছরের পুরানো বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এ নিয়মিত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নেই অনেকদিন ধরে। এক বছরে ৩ জন প্রধান নির্বাহীকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। মাত্র ৪ মাসের মাথায় তিনিও বিদায় নিলেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আবদুল মতিনের বিরুদ্ধে ছিল অনেক অভিযোগ। অন্য কোম্পানি থেকে ছাড়পত্র ছাড়া পর্ষদকে ব্যবসায়ের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এ ১২ সেপ্টেম্বর যোগদান করেন উল্লম্ফনবাজ মোহাম্মদ আবদুল মতিন। স্বল্প সময়ের মধ্যে ভূয়া শিক্ষা সনদধারী বীমা নির্বাহী মোহাম্মদ আবদুল মতিন প্রাইম ইসলামী লাইফ থেকে বেস্ট লাইফ ও মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ হয়ে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এ প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে আসেন। জানা গেছে, জীবন বীমা ব্যবসায়ে মাসে প্রথম বর্ষ ৫ কোটি ও ৫ কোটি টাকার নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় করে দিবেন এই প্রতিশ্রুতিতে তার মাসিক বেতন বাবদ ৩ লাখ এবং অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেন তিনি। মোহাম্মদ আবদুল মতিনের বিরদ্ধে অপকর্মের অভিযোগ অনেক। তিনি হোমল্যান্ড লাইফে ভূয়া ব্যবসা দেখিয়েছেন। জাতীয় পত্রিকায় নেতিবাচক খবর প্রকাশ হলে হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর মালিকদের টনক নড়ে। ২৩ অক্টোবর ‘গভীর সংকটে হোমল্যান্ড লাইফ।। আলোর আগমনে লোডশেডিং’ শিরোনামে অর্থকাগজ অনলাইনে দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশের পর গোটা বীমা খাতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর পরিচালকদের মধ্যে প্রতিবেদনটি নিয়ে বেশ তোলপাড় তৈরি হয়। বীমা খাতের নিয়ন্ত্রকের দফতরে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।
অর্থকাগজ এর অনুসন্ধানে জানা যায়, মোহাম্মদ আবদুল মতিনের স্নাতকোত্তর (ব্যবসা প্রশাসন) শিক্ষা সাময়িক সনদ সঠিক নেই। তা যাচাইয়ের লক্ষ্যে অর্থকাগজ এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. বিজয় সনকার বড়ুয়া গত ২৭ জুন, ২০২৪ জানান, মোহাম্মদ আবদুল মতিনের ছাত্র আইডি, ডিগ্রি ও অর্জিত নম্বর সবই ভূয়া।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আবদুল মতিন উন্নয়ন ও বিপণন কর্মী হিসেবে উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ২ লাখ টাকার মাসিক বেতন, কমিশন ও অন্যান্য সুবিধায় হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এ অনেকদিনের ‘মনবন্ধু’ লুৎফুন নাহার আলোকে নিয়ে আসেন। বাচাল, অপ্রয়োজনীয় কথক এবং অযৌক্তিক হস্তক্ষেপকারী লুৎফুন নাহার আলোর এ যোগদান হোমল্যান্ড লাইফের কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মীরা কেউ ভালো চোখে নেয়নি। মতিন ও আলোকে নিয়ে তারা কানাঘুষা করতেন। প্রাইম, বেস্ট ও মার্কেন্টাইলে দুজনের গভীর সম্পর্কের মুখরোচক কাহিনী বীমা পাড়ায় মুখে মুখে এখনও। মতিন আলোর ‘অনৈতিক’ কর্মকান্ডের আশংকায় চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর পর্ষদ দুজনকে বিদায় করে দেয়।
হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্সে আলোর কারণে ‘লোডশেডিং’ থামেনি। প্রতিশ্রুত ব্যবসা দিতে পারেননি লুৎফুন নাহার আলোও। আলোর জন্য অন্ধ মতিন চাকরি থেকে সরিয়ে দিয়েছেন একাধিক প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা। গত ১১ জুলাই হোমল্যান্ড লাইফে যোগদান করা উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেনকে কোন কারণ ছাড়াই চাকরি থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, ২ মাস ৮ দিনের বেতন না দিয়ে উন্নয়ন ও প্রশাসন বিভাগের এ কর্মকর্তাকে বাদ দেওয়ার ব্যাপারে বড় ভূমিকা রাখেন লুৎফুন নাহার আলো। সাবেক উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন কোম্পানি থেকে তার পাওনা আদায়ের জন্য বহুবার কোম্পানির কাছে ধর্ণা দিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি; তার কারণ ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আবদুল মতিন এবং লুৎফুন নাহার আলোর হস্তক্ষেপ! মো. শাহাদাত হোসেন বিনা কারণে চাকারচ্যুতি এবং পাওনার জন্য সুবিচারের প্রত্যাশায় অবশেষে প্রশাসনের স্মরণাপন্ন হন। পুলিশ মোহাম্মদ আবদুল মতিনকে খুঁজে বেড়ায়। পুলিশের ভয়ে মতিন রাজধানীর মতিঝিলস্থ হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্সের অফিসে খুব একটা আসতেন না। একটি সূত্র জানায়, লুৎফুন নাহার আলো পুলিশের সঙ্গে বসে বিষয়টি ফয়সালা করেন। মতিন আলোর যৌথ কর্মকাণ্ডে মাঠ, প্রশাসন ও হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। কোম্পানির পর্ষদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর অবধি ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আবদুল মতিন ব্যবসায়ে কী অবদান রাখেন তার দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর প্রথম বর্ষ ও নবায়ন ব্যবসা ২০২৪ সালে আগের বছরের তুলনায় অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। ●
অকা/জীবীকো/বিপ্র /দুপুর/১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 months আগে