অর্থকাগজ ডেস্ক ●
করোনা মোকাবিলা করে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে চীনের অর্থনীতি। তবে করোনার আগেই কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তারা। এখন দেশটির সামনে নানা চ্যালেঞ্জ। তার মধ্যে অন্যতম ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠী, কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়া ও ক্রমবর্ধমান মজুরি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে দেশটি যে সমাধান খুঁজে নিয়েছে, তা হলো অটোমেশন। দেশটির বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও এখন সেই পথে হাঁটছে। ফলে দ্রুত বদলে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মপরিবেশ।
সম্প্রতি বিএনসিসির এক প্রতিবেদক চীনের বৃহত্তম খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান জেডি ডট কমের কারখানা ঘুরে এসেছেন। বিশাল এই প্রতিষ্ঠান দিনে ১৪ লাখ ক্রয়াদেশ বা অর্ডার সরবরাহ করতে পারে। আর তাতে যন্ত্র এখন বেশ কাজে লাগছে। সেখানকার কর্মীরা বলছেন, অটোমেশনের পর এখন গুদামে অর্ধেক শ্রমিকের কাজ যন্ত্র করে দিচ্ছে। ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা যায়, গ্রাহকদের অর্ডার কোন কোন অঞ্চলে সরবরাহ করা হবে, তা সর্টিং বা বাছাই হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কর্মীর প্রয়োজন হচ্ছে না সে জন্য।
সিএনবিসির প্রতিবেদক অর্জুন খারপাল জানান, গত এক দশকে চীনের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৫০ লাখ। সে কারণে দেশটিতে অটোমেশন জরুরি হয়ে পড়েছে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার অর্থ হলো, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি। ফলে ধনী দেশ হওয়ার আগে চীনের অবস্থা জাপানের মতো হতে যাচ্ছে, অর্থাৎ তরুণের চেয়ে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি।
জেডি ডট কমের এক ব্যবস্থাপক বলেন, অটোমেশনের সুবিধা অনেক। এতে জটিল প্রক্রিয়া সহজ হয়ে যায়। কর্ম প্রক্রিয়ার দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচও বাঁচে। কর্মীদের ভাষ্যমতে, প্রথম পরিবর্তন এসেছে কর্মঘণ্টায়। আগে প্রায়ই ওভারটাইম করতে হতো তাদের, কিন্তু এখন তা করতে হচ্ছে না। ৮ থেকে ৯ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, আগে যেখানে কর্মীদের ১২ থেকে ১৩ হাজারবার পা ফেলতে হতো, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ থেকে ৬ হাজারে। আগে কী কাজ করতেন আর এখন কী কাজ করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বলেন, আগে প্যাকেজগুলো শেলফে থরে থরে সাজিয়ে রাখতে হতো। কিন্তু এখন কোন প্যাকেজ কোন শেলফে থাকবে, তার পুরো প্রক্রিয়া যন্ত্রে সম্পন্ন হচ্ছে। হাতে গোনা যে কজন কর্মী এখন কাজ করেন, তাঁদের কাজ হচ্ছে যন্ত্র পরিচালনা করা।
১৯৪০ সাল থেকে ১৯৮০ সালে সময় চীনের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু এক সন্তান নীতির কারণে তার পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে আসে। ২০২০ সালে দেশটির জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪০ কোটি, যা যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার চার গুণেরও বেশি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে চীনে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে যাওয়ার অর্থ হলো উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া। আর ঠিক সেখানেই অটোমেশনের কাজ, যা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের ভাষ্যমতে, চীনের আর্থিক খাতের কর্মীদের উৎপাদনশীলতা পাঁচ-ছয় বছর আগে ইউরোপের ২০ থেকে ৩০ শতাংশের সমপরিমাণ ছিল। এখন তা ৫০-৬০ থেকে শতাংশে উঠেছে। অর্থাৎ উন্নতি হলেও এখনো তারা পিছিয়ে আছে।
অটোমেশনের সঙ্গে চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশেও কাজ করছে। গুয়াংজু শহর এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত চালকবিহীন গাড়ির বড় পরীক্ষা ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
স্টার্টআপ উই রাইডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, কর্মীর সংকটের কারণেই মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত চালকবিহীন গাড়ির দিকে ঝুঁকছে তারা। এ ছাড়া শ্রমিকের মজুরি দিন দিন বাড়ছে। তাদের ভাষ্যমতে, চালকবিহীন গাড়ির কারণে শহরে গাড়ির সংখ্যাও কমবে। এক গাড়ি অনেকবার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। তাতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ কমবে। অটোমেশনের পরিণামে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় বহু মানুষ কাজ হারাবে। ম্যাককিনসে ইনস্টিটিউটের ভাষ্যমতে, ২০৩০ সালের মধ্যে চীনের ২২ কোটি মানুষকে নতুন কাজে যেতে হতে পারে। অর্থাৎ অটোমেশনের কারণে তাঁদের নতুন দক্ষতা রপ্ত করতে হবে। অটোমেশনের বদৌলতে কোভিডের প্রভাব হয়তো দ্রুতই কাটিয়ে উঠবে চীন, কিন্তু শ্রমঘন দেশের জন্য তা অশনিসংকেত। মূল প্রভাব পড়বে দক্ষ শ্রমিকদের ওপরও। মজুরি বাড়ানোর দর-কষাকষির ক্ষমতা কমে যাবে তাঁদের। অন্যদিকে উচ্চ দক্ষতার কর্মীদের মজুরি বাড়বে, কারণ, তখন মূল কাজটা হবে যন্ত্র পরিচালনা। এ বাস্তবতায় নতুন সামাজিক চুক্তির প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হবে।
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 years আগে
