তারেক আবেদীন ●
দেশের বীমা কোম্পানিতে বেশ কজন অযোগ্য মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (এমডি) দীর্ঘ সময় ধরে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন! ‘ভূয়া’ শিক্ষা সনদে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশের একাধিক কোম্পানি বিশেষ করে দেশীয় বীমা কোম্পানিতে এমডি পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন দিনের পর দিন। অযোগ্য এসব বীমা প্রধান নির্বাহীর অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বীমা খাতে ব্যাপকভাবে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। দাবী সময়মত পরিশোধ না করা, মেয়াদ শেষে গ্রাহকের অর্থ পরিশোধ না করে জোরপূর্বক পলিসি করানো, টানা পলিসি (টিপি), দাবীর টাকা না দেওয়া, অনুমোদনহীন পণ্য বিক্রয়, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, হিসাবে গোজাঁমিল, সরকারের মূসক (ভ্যাট) ও কর ফাঁকি দিয়ে সে অর্থে অতিরিক্ত কমিশনে ব্যবসা, ট্যারিফ রেট না মানা, কভারনোট জালিয়াতি, পুনবীমা না করে মক্কেলকে ব্যবসায়ে পথে বসিয়ে দেওয়া, পরিশোধিত মূলধন ভেঙ্গে কোম্পানি পরিচালনা, তহবিল তছরূপ, মুখ্য নির্বাহীর বয়সের অযোগ্যতা এবং স্বপদে তার সময়কালের অযোগ্যতা ইত্যাদি বীমা কোম্পানিগুলোতে বিদ্যমান। এসব কারণে আইন মেনে ব্যবসা করা ভালো কোম্পানিগুলো ব্যবসা পরিচালনায় মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে তাদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।
তবে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এর চেয়ারম্যান এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সচিব ড. এম আসলাম আলম ৯ সেপ্টেম্বর যোগদান করার পর থেকে বীমা খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। চার মাসাধিকাল সময়ে তিনি অনিয়মের জন্য বেশ কটি লাইফ ও নন কোম্পানিকে জরিমানা করেছেন এবং সতর্কমূলক পত্রও দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়মিত বসছেন। বর্তমান বীমা আইন ও প্রবিধানমালা সময়োপযোগী করার জন্য তিনি তৎপর হয়েছেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশে পরিচালিত লাইফ ও নন লাইফ মিলিয়ে ৮১টি বীমা কোম্পানীর মধ্যে ১৪টি বীমা কোম্পানিতে নিয়মিত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নেই। এরমধ্যে একাধিক বীমা কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ভারপ্রাপ্ত ও চলতি দায়িত্বে বীমা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। অনিয়মিত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা রয়েছেন লাইফের ৯ জন এবং নন লাইফের ৫ জন। মুখ্য নির্বাহী পদে ভারপ্রাপ্ত ও চলতি দায়িত্বরত লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো হলো- গার্ডিয়ান, সোনালী, আকিজ তাকাফুল, মার্কেন্টাইল ইসলামী, ডায়মন্ড, ফারইষ্ট ইসলামী, বায়রা, সানলাইফ ও হোমল্যান্ড। এ ক্ষেত্রে নন লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো হলো- জনতা, রূপালী, ফিনিক্স, মেঘনা ও কন্টিনেন্টাল।
অর্থকাগজ এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, বহুদিন ধরে বীমা পেশায় সংপৃক্ত ১০ জন বীমা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানে ‘ভূয়া’ শিক্ষা সনদ জমা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কারো কারো শিক্ষা সনদ ও কর্মকাণ্ডও বিতর্কিত। লাইফ বীমার মধ্যে ‘ভূয়া’ শিক্ষা সনদ ও বিতর্কিত সনদে অভিযুক্ত এবং পরে প্রমাণিত প্রথম প্রজন্মের বীমা কোম্পানির একজনসহ দ্বিতীয় প্রজন্মের ১ জন, তৃতীয় প্রজন্মের ৪ জন এবং চতুর্থ প্রজন্মের প্রজন্মের ৩ জন এবং নন লাইফ বীমা কোম্পানি একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে ভূয়া সনদ জালিয়াতির অভিযোগ নিয়ে অর্থকাগজসহ দেশের বহু সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হলেও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান তাদের অপসারিত করেনি। নিয়মিত এমডি নিয়োগ না করে ছয় মাসের অধিক প্রায় ৪ বছর বছর চলতি দায়িত্বে আছেন গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ রাকিবুল করিম। এরজন্য চতুর্থ এ প্রজন্মের বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডকে ৫ লাখ জরিমানা করে ২৭ জানুয়ারি চিঠি পাঠিয়েছে আইডিআরএ। গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড এর চেয়ারম্যানকে লিখিত ৫৩.০৩.০০০০.০৩২.১১.০০২.২১.১৮ স্মারক নম্বরের সে পত্রে বলা হয়, গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রায় ৪ বছর ধরে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ না দিয়ে বীমা আইন ২০১০ এর ৮০ ধারা লংঘন করেছে। জরিমানার টাকা ১৫ দিনের মধ্যে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এর নামে ব্যাংক পে অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়। আগামী ৬০ দিনের মধ্যে কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়। তা না করা হলে পুনরায় ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে বলে আইডিআরএ থেকে কোম্পানিকে জানানো হয়েছে।
দীর্ঘ সময় চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি এর চলতি দায়িত্বে থাকা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরীর নিয়োগ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে আইডিআরএ ৯ জানুয়ারি। নাকচের কারণ হিসেবে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান থেকে উল্লেখ করা হয়- প্রতারণার মাধ্যমে মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরীর দাখিলকৃত শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ সংগৃহীত হয়েছে। কোম্পানিটির চেয়ারম্যানকে লিখিত চিঠিতে (স্মারক নম্বর-৫৩.০৩.০০০০.০৩২.১১.০০২.২২.৭) আড়াই মাস আগে কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্নপদে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। আইডিআরএ’র নিয়োগ প্রস্তাব নাকচের বিরুদ্ধে মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী উচ্চ আদালতে একটি রীট আবেদন (১৬২১১/২০২৪) করেছেন বলে অর্থকাগজকে জানান।
নাম না প্রকাশ করার সত্ত্বে অভিজ্ঞ একজন প্রধান বীমা নির্বাহী কর্মকর্তা অর্থকাগজকে বলেন, সামর্থ্যবান কোম্পানিগুলোর অযোগ্য সিইওর পিছনে কোম্পানি তিন মাস পর পর জরিমানা দিয়ে যাবেন! ফলে এক সময় সে এমডি যোগ্য হয়ে যাবেন। তাতে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কোষাগারে কিছু অর্থ জমা হলো। এতে করে সরকারও লাভবান হলো। কিন্তু অন্যায় ও অনিয়মতো থেকেই গেল! অযোগ্য মুখ্য নির্বাহীদের পরিচালনায় দেশের বীমা কোম্পানির ভাবমুর্তি নষ্ট হয়ে গেছে। বীমায় কাজ করি তা বলতে আজকাল অনেক সময় সংকোচ ও কণ্ঠাবোধ করি। তিনি আরো বলেন, দেশের বীমা মালিক ও প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ) এর নেতৃত্বে বিতর্কিত ও অযোগ্যরাও আসছেন। নেতৃত্বের কারণে ক্ষমতাবান হয়ে এরাই নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব খাটাবেন। দলীয় সরকার গঠিত হলে আবার বীমা খাতের ‘যেইসেই’ অবস্থা হবে! সর্বদা খারাপ উদ্যেক্তা এবং বীমার এমডিরা সুবিধাবাদী। অস্তিত্বের জন্য বীমা শিল্পের উন্নয়নে তাই ব্যাপক সংস্কার এবং এর কার্যকর প্রতিপালন জরুরি। ●
অকা/বিপ্র/বীখা/বিকেল/১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 8 months আগে