অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে শ্লথ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। আগের অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ০ দশমিক ৫৩ শতাংশ পয়েন্ট, যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধীরগতির ইঙ্গিত দেয়।
বিবিএস তাদের কোয়াটারলি জিডিপি (কিউজিডিপি) প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ কোয়ার্টার, অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে প্রাথমিক হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা দ্বিতীয় কোয়ার্টারের ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশের তুলনায় কম। এতে স্পষ্ট হয় যে, অর্থবছরের শেষভাগে এসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও মন্থর হয়ে পড়েছে।
তবে আগের বছরের তুলনায় একটি ইতিবাচক দিকও রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে (চতুর্থ কোয়ার্টারে) প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ১৪ শতাংশ, যা তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ কোয়ার্টারে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কমলেও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সামান্য পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখা গেছে।
বিবিএসের তথ্যমতে, চলতি মূল্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ কোয়ার্টারে জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪০১ বিলিয়ন টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে তা ছিল ১৩ হাজার ১৭৭ বিলিয়ন টাকা। অর্থাৎ নামমাত্র মূল্যে অর্থনীতির আকার বেড়েছে, কিন্তু বাস্তব প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এটি মূলত মূল্যস্ফীতির প্রভাবেই হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা।
খাতভিত্তিক বিশ্লেষণেও স্পষ্ট হচ্ছে অর্থনীতির ভেতরে অসম ভারসাম্য। কৃষি খাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ কোয়ার্টারে সাময়িক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ০১ শতাংশ, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ১১ শতাংশ। কৃষিতে এই প্রবৃদ্ধি হ্রাসের পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত, এবং উৎপাদন ব্যয়ের বৃদ্ধি—যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাপে ফেলেছে।
অন্যদিকে, শিল্প খাতে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এই খাতে চতুর্থ কোয়ার্টারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ১০ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ১ দশমিক ০৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রপ্তানিমুখী শিল্পে কিছুটা চাহিদা পুনরুদ্ধার, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের অর্ডার বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছুটা স্থিতিশীলতা শিল্পখাতকে সাময়িক স্বস্তি দিয়েছে।
সেবা খাতে প্রবৃদ্ধির হারও তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ কোয়ার্টারে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৯৬ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ০৬ শতাংশ। পরিবহন, যোগাযোগ, ব্যাংকিং ও খুচরা বাণিজ্য খাতের কিছু দুর্বলতা এ প্রবৃদ্ধিকে সামান্য নিচে নামিয়েছে।
সার্বিকভাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির এ নিম্নগতি বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতিফলন। বিনিয়োগে স্থবিরতা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, এবং ব্যাংক খাতে অনিয়মের কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতি কমে গেছে।
যদিও নামমাত্র অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে বাস্তব প্রবৃদ্ধির এই শ্লথ গতি দেশের কর্মসংস্থান, ক্রয়ক্ষমতা এবং বিনিয়োগ প্রবাহে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এই ধারা রোধ করতে হলে উৎপাদন খাতে প্রণোদনা বৃদ্ধি, কৃষিতে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ এবং আর্থিক খাতে আস্থা পুনরুদ্ধার জরুরি হয়ে পড়েছে।
সংক্ষেপে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্বল দিকগুলোকে উন্মোচিত করেছে—যেখানে শিল্প কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও কৃষি ও সেবা খাতে ধীরগতি এবং সামগ্রিক বিনিয়োগে স্থবিরতা দেশের অর্থনৈতিক গতি পুনরুদ্ধারে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। ●
অকা/প্র/ই/সকাল/১১ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 days আগে