অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সরকার এবার এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের মোট নয়টি নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন (এনবিএফআই) বা লিজিং কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে—যা সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বুধবার (৮ অক্টোবর) রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি জানান, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদকে অবহিত করেন।
বৈঠকে দেশের আর্থিক খাতের সামগ্রিক দুরবস্থা ও সংস্কার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেখানে গভর্নর মনসুর স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, বেশ কিছু লিজিং কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, ঋণ খেলাপি, ও মূলধন ঘাটতির কারণে বাজারের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ণ করছে এবং সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
গত এক দশকে এনবিএফআই খাতটি ব্যাংক খাতের মতোই নানা ধরনের অনিয়ম, খেলাপি ঋণ, ও সম্পদ অপব্যবহারে জর্জরিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অনেক লিজিং কোম্পানি প্রকৃত লিজিং ব্যবসার পরিবর্তে অস্বচ্ছ ঋণ বিতরণ, সম্পদ আত্মসাৎ, এমনকি আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার অবশেষে দীর্ঘ আলোচনার পর সবচেয়ে দুর্বল নয়টি প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার এক দৃঢ় বার্তা বহন করছে।
যদিও এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক কোন প্রতিষ্ঠানগুলো অবসায়নের আওতায় আসছে, তার তালিকা প্রকাশ করেনি। প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, “গভর্নরের বক্তব্যে তালিকা উল্লেখ করা হয়নি, তবে বাংলাদেশ ব্যাংক খুব শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তারিত জানাবে।”
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা সরকারের এই পদক্ষেপকে “প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী” বলে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, অনিয়মে জর্জরিত ও দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে থেকে গেলে শুধু বিনিয়োগকারীদের আস্থাই ক্ষুণ্ণ হয় না, বরং পুরো আর্থিক ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. তামিম আহমেদ বলেন, “এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, আর্থিক খাতে এখন আর দুর্বল ও অসৎ প্রতিষ্ঠানের জায়গা নেই। এটি দীর্ঘমেয়াদে ভালো প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করবে।”
তবে বিশেষজ্ঞরা একই সঙ্গে সতর্ক করেছেন যে, এই অবসায়ন প্রক্রিয়াটি অবশ্যই স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীলভাবে সম্পন্ন করতে হবে। আমানতকারী ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের আর্থিক খাতে কাঠামোগত সংস্কারের একটি সূচনা হতে পারে। যদি স্বচ্ছভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং ভবিষ্যতে শক্তিশালী ও টেকসই আর্থিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করবে।
সামগ্রিকভাবে, নয়টি লিজিং কোম্পানি বন্ধের এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই দেশের আর্থিক খাতের ‘ক্লিন-আপ’ প্রক্রিয়ার সূচনা হিসেবে দেখছেন। এটি শুধু দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছেঁটে ফেলার পদক্ষেপ নয়, বরং আর্থিক শাসন ও স্বচ্ছতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। ●
অকা/আখা/ই/সকাল/৯ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 5 days আগে