প্রণব মজুমদার

সভ্যতার পথ বেয়ে নারী আজ সকল কাজে পুরুষের সহযোগী। শুধু সংসারের গৃহস্থালিতে নারী নিজেকে ব্যাপৃত রাখেনি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীর এই আত্মউন্নয়ন ছিল না। বিংশ শতাব্দীতে রাতারাতি পাল্টে গেছে রক্ষণশীল সেই মনোভাব। পরিশীলিত হয়েছে নারীমন। ব্যবহারিক, কারিগরি এবং পদ্ধতিগত শিক্ষামনস্কতা তাদের পুরুষ শাসনের বেড়াজালে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। আঁধার থেকে বেরিয়ে নারী চোখ রেখেছে বহিরাঙ্গনে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কিংবা সাংসারিক সর্বোপরি সকল কাজে নারী এখন পুরুষের সঙ্গী। বাংলাদেশ রফতানির বড় খাত তৈরি পোশাক কারখানায় নারী সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে।
কোথায় নেই নারী ? সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, মহাকাশ বিজ্ঞান, অফিস আদালত, বিশ্ব নেতৃৃত্বে সব জায়গায় পুরুষের পাশাপাশি এখন নারীরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের শ্রমশক্তি জরীপের উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে শ্রমজীবি মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৩৫ লাখ। পুরুষ ৪ কোটি ৩৫ লাখ এবং মহিলা ২ কোটি। প্রায় অর্ধেক। এমন পরিসংখান আগে আশাই করা যেতো না। অতিমারির ক্রান্তিকালে দেশের মেয়েরা অনলাইনে ব্যবসাযের মাধ্যমে স্বনির্ভরতার পথ খুঁজে পেয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য বলছে, এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর দেয়া এক তথ্য মতে, অনলাইন লেনদেন ২০১৭ সালে ১২শ কোটি টাকার মতো ছিল। ১৮ ও ১৯ সালে যথাক্রমে ৩ ও ৪ কোটি টাকা করে লেনদেন বেড়েছে। ২০২০ এ এসে এই বাজার দুই হাজার কোটি টাকা বেড়ে ৪ হাজার কোটি টাকায় উত্তীর্ণ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
আধুনিক উন্নত বিশ্বে নারীর দ্রুত উন্নতি ঘটলেও তৃতীয় বিশ্বে এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে বেশ পরে। অশিক্ষার কারণে রক্ষণশীলতা এবং পুরুষের আধিপত্যবাদ ও হীনমন্যতা নারীকে ঘরের অন্তঃপুরেই রেখেছে। উপমহাদেশে এমনটির পাশাপাশি নারীর ভূমিকা সেদিনও ছিল একজন রাঁধুনি হিসেবে। নারী মানেই ছিল গৃহের আটপৌরে বস্তু। অবগুণ্ঠিত ও অন্ধকারে ঢেকে রাখা নারী ছিল নিভৃতচারিণী। নারীমনের স্বাধীনতা ছিল না। কেননা নারীর দু’পায়ে ছিল অন্নদাতার শৃঙ্খল। আমাদের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ আগের চেয়ে অনেক স্ফীত হলেও নারী লাঞ্চনার হার বেড়েছে।
১৮৮৬ সালে মে মাসে আমেরিকাজুড়ে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকক শ্রেণী ঘর্মঘট করেছিল। শ্রমিকদের এই উদাত্ত আহ্বানে নিউইয়র্কের নারী শ্রমিকরাও সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিল। আন্দোলনের ফলে শিকাগোর হে মার্কেটে এক কলঙ্কজনক ইতিহাস সূচিত হয়।
পুঁজিবাদের প্রথম যুগে কাজের ঘণ্টার কোন বালাই ছিল না। চৌদ্দ ষোলো, আঠারো এমনকি কুড়ি ঘণ্টাও কাজ করতে হতো শ্রমজীবী মানুষকে। সারা দুনিয়ার খেটে খাওয়া মানুষরা পুঁজিবাদী মুনাফলোভী মালিকদের দ্বারা নির্যাতিত হতো। পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারজন শ্রমিক স্পাইজ, ফিশার, এঞ্জেল ও ফিসারের আত্মাহুতি অর্থাৎ ফাঁসির কাষ্ঠে জীবদানের মাধ্যমে রচিত করে গেছেন বিশ্ব ইতিহাস যা এখন ঐতিহাসিক মে দিবস হিসেবে পরিচিত।
মে দিবসের প্রেক্ষাপটে আজকের বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত? দেশের শ্রমবাজারে বিশেষ করে নারীর মূল্য কোথায়? দেশে একজন গার্মেন্টস নারী শ্রমিক কি মে দিবসের ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার সৃষ্টি করতে পেরেছে? শ্রমের সময়কালের কথা না হয় বাদই দিলাম। তারা কি পাচ্ছে তাদের উপযুক্ত মঞ্জুরি? কিংবা ন্যূনতম মজুরিটুকুও কি একজন নারী শ্রমিক পাচ্ছে নিয়মিত? মূল্যস্ফীতির প্রবল জোয়ারে মহানগরে একজন নারী পোশাক শ্রমিক খেয়ে পড়ে মাসিক মজুরি ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা কি তার স্বাভাবিক জীবন ধারণের জন্য উপযুক্ত ?
১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এ দেশে পোশাক শিল্প কারখানা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। নারীর সস্তা শ্রমকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব বাজারে চাহিদা এবং নারী শ্রমের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চনার কারণেই তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের প্রবৃদ্ধি বাড়ে। কিন্তু জীবন মান বাড়ে না দেশের নারী শ্রমিকের।
পাড়াগাঁয় আজকাল ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজদের দ্বারাই কেবল নারী নির্যাতিত হচ্ছে না, শহরের কারখানায় মালিকদের হাতেও নারীর সম্ভ্রমহানি হচ্ছে। কখনো কখনো এরা যৌন উৎপীড়নের শিকার হয়। অর্থের কাছে যখন জীবিকা পরাজিত তখন এসব ঘটনা অনেক সময় প্রকাশ হয় না। নিভৃতের চাপা পড়ে যায় এসব ঘটনা।
পহেলা মে শ্রমিক দিবসের প্রেক্ষাপটে উন্নত বিশ্বের দিকে মুখ ফিরালে আমরা চরম হতাশাগ্রস্ত হই। নারী-পুরুষের কোন প্রভেদ নেই সেখানে। উন্নত বিশ্বে দক্ষ শ্রমিকের মর্যাদা বৃদ্ধি পেলেও এদেশে এর চেহারা সম্পূর্ণ বিপরীত। উন্নত বিশ্বের শিল্প কারখানা মালিকদের সঙ্গে আমাদের তফাত এটাই যে- আমরা নারী শ্রমের ততটা মূল্য দেই না। ওরা দেয়। ওদের কাছে নারী-পুরুষ সমান। দক্ষতাই যেখানে মুখ্য।
আমাদের দেশে নারী এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো নারীর দৈহিক নির্যাতন নিয়ে তাদের যতটা বেশি সোচ্চার, তার চেয়ে অতিশয় কম মাথাব্যথা নারী শ্রমে মানবাধিকারের প্রশ্নে। অর্থাৎ শ্রমবাজারে নারীরা যে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হচ্ছে, সঠিক এবং ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না সেদিকে তাদের দৃষ্টি একবারেই কম!

লেখক সাহিত্যিক এবং অর্থকাগজ সম্পাদক

writerpranabmajumder@gmail.com


সর্বশেষ হালনাগাদ 4 years আগে

Leave A Reply

Exit mobile version