অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

২০২৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে ঘিরে ছিল এক ধরনের নৈরাশ্য। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বাড়তি আমানত ব্যয়, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ঋণচাহিদার অবসাদ—সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর মুনাফা সঙ্কুচিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো। বছরের প্রথম নয় মাসে দেখা গেছে, একাধিক বেসরকারি ব্যাংক রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করেছে—ঋণ সম্প্রসারণ বা নতুন ব্যবসায়িক সাফল্যের কারণে নয়, বরং সরকারি বন্ড ও ট্রেজারি বিল থেকে প্রাপ্ত আয়ের কারণে। সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ এখন ব্যাংকগুলোর জন্য একপ্রকার “নতুন নিরাপদ ব্যবসা মডেল”—যা খাতটির আয়ের কাঠামো ও ঝুঁকির ধরন পুরোপুরি বদলে দিয়েছে।

২০২৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এমটিবি, প্রাইম ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া এবং ডাচ-বাংলা ব্যাংক—সবক’টির আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে সরকারি বন্ড ও বিল থেকে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই আয়ের হার গড়ে মোট পরিচালন আয়ের অর্ধেকেরও বেশি, যেখানে ২০২২ সালে তা ছিল এক-তৃতীয়াংশেরও নিচে। ব্র্যাক ব্যাংকের পরিবর্তন সবচেয়ে নাটকীয়। ২০২০–২২ সালে যেখানে বিনিয়োগ আয় ছিল ৭০০–৮০০ কোটি টাকার মধ্যে, ২০২৪ সালে তা লাফিয়ে দাঁড়ায় ২,৮৮০ কোটি টাকায়—মাত্র দুই বছরে প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি। ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে নিট মুনাফা ৫০% বেড়ে দাঁড়ায় ১,৫৫৩ কোটি টাকায়, যদিও নেট ইন্টারেস্ট ইনকাম (ঋণ-আমানতের সুদ পার্থক্য) কমেছে ৭%। অর্থাৎ ব্যাংকের মুনাফা এখন প্রায় পুরোপুরি ট্রেজারি আয়ের ওপর নির্ভরশীল। জানুয়ারি–সেপ্টেম্বরে এই আয় ৭৩% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩,৩৯৪ কোটি টাকায়, যা অপারেটিং ইনকামের ৫৫%। ব্যাংকের এমডি তারেক রেফাত উল্লাহ খান সতর্ক করে বলেছেন, “বন্ডের এই উচ্চ আয় অস্থায়ী—এটি স্থায়ী ব্যবসায়িক সমাধান নয়।”

সিটি ব্যাংকের আয়ের ধরন এখন প্রায় একমুখী। ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা বেড়েছে ৬০%, পৌঁছেছে ৭২২ কোটি টাকায়—এর প্রায় পুরোটাই এসেছে সরকারি সিকিউরিটিজ থেকে। বিনিয়োগ আয় এক বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৭৭৫ কোটি টাকায়, যা এখন মোট আয়ের ৭৭%। বিপরীতে, নিট সুদ আয় ৮৭% হ্রাস পেয়ে ১,১৭২ কোটি টাকা থেকে নেমেছে ১৫০ কোটিতে। অর্থাৎ ঋণ ব্যবসা প্রায় নিস্তেজ। একজন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, “সিটি ব্যাংকের প্রকৃত সাফল্য ট্রেজারি ডেস্কে—ঋণ পোর্টফোলিও নয়।”

ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) সাধারণত রক্ষণশীল বিনিয়োগ নীতির জন্য পরিচিত। কিন্তু তারাও বন্ড বাজারের ঢেউ থেকে বাদ যায়নি। ২০২০–২৪ সময়ে বিনিয়োগ আয় ৫০৫ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১,০১৭ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে তা আরও ৩৯% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,০৯৫ কোটিতে—এখন ব্যাংকের মোট আয়ের ৪৮% এই উৎস থেকে আসে। অন্যদিকে, নিট সুদ আয় ১০% কমে ৭১২ কোটি টাকায় নেমেছে। ইবিএলের ৮৬% বিনিয়োগ এখন সরকারি সিকিউরিটিজে, যা ২০২০ সালে ছিল ৭৯%।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) নিট সুদ আয় ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে ৫৮% কমে ২৬৩ কোটিতে নেমেছে, কিন্তু বিনিয়োগ আয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৯৭৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ফলে মোট পরিচালন আয়ের ৬০% এখন আসে ট্রেজারি থেকে—যেখানে এক বছর আগে এই হার ছিল ৩৭%। ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “ঋণচাহিদা কমে গেছে, খেলাপি ঋণ বেড়েছে—ফলে মূল ব্যাংকিং আয়ের জায়গা একেবারেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে।”

প্রাইম ব্যাংকও একই পথে হেঁটেছে। ২০২৪ সালে ব্যাংকটির বিনিয়োগ আয় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ১,০২৭ কোটি টাকা, যা ট্রেজারি বিল ও বন্ডের উচ্চ রিটার্ন থেকে এসেছে। ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে নিট সুদ আয় ৭৩৯ কোটি থেকে নেমে ৩৭৫ কোটিতে এলেও মোট অপারেটিং আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৯৬২ কোটি টাকায়। এই প্রবৃদ্ধির ৬০% এসেছে বিনিয়োগ আয়ের উল্লম্ফন থেকে।

ব্যাংক এশিয়ার নিট সুদ আয় ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে নেতিবাচক হয়ে গেছে—৩৫৩ কোটি টাকার মুনাফা থেকে ক্ষতি হয়েছে ১১০ কোটি। তবু ব্যাংকটি টিকে আছে কারণ বিনিয়োগ আয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ১,২৪৮ কোটিতে পৌঁছেছে। এখন ব্যাংকের মোট আয়ের ৯০% এরও বেশি আসে সরকারি বন্ড থেকে—যা কাঠামোগত ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়।

ডাচ-বাংলা ব্যাংক ২০২৪ সালে ১,০৪৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ আয় করেছে, যা ৩০% বৃদ্ধি নির্দেশ করে। কিন্তু ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ট্রেজারি আয় ১২৭% বেড়ে ৯৩৫ কোটিতে পৌঁছেছে, আর নিট সুদ আয় ১৩% কমেছে। এখন ব্যাংকের মোট পরিচালন আয়ের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বন্ড থেকে আসে। ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, “সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ মানে উচ্চ মুনাফা, শূন্য ঝুঁকি—এই বাস্তবতায় ব্যাংকগুলোর বিকল্প কম।”

ব্যাংকগুলোর এই ঝোঁকের পেছনে রয়েছে সরকারের ঋণগ্রহণের নীতি। ২০১৯–২০ অর্থবছরে ২.৯ লাখ কোটি টাকার সরকারি সিকিউরিটিজ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৫.৮ লাখ কোটি টাকা—অর্থাৎ পাঁচ বছরে দ্বিগুণের বেশি। ট্রেজারি বন্ড বেড়েছে ৮৮% হয়ে ৪.০৭ লাখ কোটি টাকায়, আর ট্রেজারি বিল দ্বিগুণ হয়ে ১.৩৩ লাখ কোটি টাকায়। একইসঙ্গে সুদের হারও এক দশকের সর্বোচ্চে পৌঁছেছে—মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে ১২–১৩% পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো অপারেশন ও তারল্য সহায়তা পাঁচ বছরে ছয়গুণ বেড়ে ৩ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। বাহ্যিক ঋণও প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৯.৮১ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা জিডিপির ১৯.৫%। তবে সেপ্টেম্বর থেকে বন্ডের সুদের হার কিছুটা কমেছে—৯১ দিনের ট্রেজারি বিল ১০.০৮% থেকে নেমে এসেছে ৯.৯১%-এ, যা তারল্যের সামান্য উন্নতির ইঙ্গিত দেয়।

বেশিরভাগ ব্যাংক এমডি এবং ট্রেজারি প্রধানরা আশাবাদী যে, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ঋণচাহিদা বাড়বে। ব্র্যাক ব্যাংকের তারেক রেফাত উল্লাহ খান বলেন, “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলে অবকাঠামো ও শিল্পখাতে বিনিয়োগ ফিরে আসবে।” এমটিবির সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের ভাষায়, “সবাই অপেক্ষা করছে নির্বাচনের ফলাফলের জন্য—আস্থা ফিরলেই ঋণচাহিদা বাড়বে।”

তবে অর্থনীতিবিদদের সতর্কবার্তা ভিন্ন। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, বন্ডে বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোর জন্য স্বল্পমেয়াদি নিরাপদ আশ্রয় হলেও, এটি দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং খাতের কাঠামোগত দুর্বলতার প্রতিফলন। তিনি বলেন, “যদি রাজস্ব আহরণ বাড়ানো না যায়, তাহলে অভ্যন্তরীণ ঋণভার দ্রুত বাড়বে এবং তা রাজস্ব স্থিতিশীলতার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।”

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখন কার্যত ঋণনির্ভর অর্থনীতির বদলে ‘বন্ডনির্ভর’ মডেলে প্রবেশ করেছে। এটি স্বল্পমেয়াদে মুনাফা টিকিয়ে রাখলেও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি বহন করছে—কারণ অর্থনীতির আসল চালিকা শক্তি, বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি, তাতে স্থবির হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিল্প বিনিয়োগ এবং ঋণচাহিদা পুনরুদ্ধার না হলে, ট্রেজারির এই কাগজ-নির্ভর মুনাফা অচিরেই বাস্তব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিকল্প হতে পারবে না।
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/৩ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 12 hours আগে

Leave A Reply

Exit mobile version