অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে সরকারের ঘোষিত সর্বশেষ সংশোধিত মজুরি কাঠামো কার্যকর হলেও, তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত প্রায় ১৩ শতাংশ শ্রমিক এখনো নতুন বর্ধিত মজুরি কাঠামোর পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছেন না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আংশিকভাবে বর্ধিত মজুরি পেয়েছেন, আবার কেউ এখনো পুরোনো কাঠামো অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন।

গবেষণাটি ২০২৫ সালের মে ও জুন মাসে পরিচালিত হয়, যেখানে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম জেলার ৬০টি তৈরি পোশাক কারখানার ২৪০ জন শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এই ফলাফল তুলে ধরা হয় রোববার (২৬ অক্টোবর) রাজধানীর এক হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে, যেখানে উপস্থাপন করা হয় “বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন: বাস্তবায়নের অবস্থা ও শ্রমিকদের ওপর প্রভাব” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন। অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে আওয়াজ ফাউন্ডেশন, মন্ডিয়াল এফএনভি’র সহযোগিতায়। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার।

সরকার ২০২৩ সালে পোশাক শিল্পের প্রবেশ পর্যায়ের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১২,৫০০ টাকা নির্ধারণ করে, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক জাকির হোসেন গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, জরিপে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৮৭ শতাংশ নতুন কাঠামো অনুযায়ী পূর্ণ মজুরি পাচ্ছেন, তবে বাকি ১৩ শতাংশের মধ্যে ৮ শতাংশ আংশিকভাবে এবং ৫ শতাংশ এখনো সংশোধিত গ্রেড অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন না।

তিনি আরও জানান, জরিপে অন্তর্ভুক্ত কারখানাগুলো ছিল নিট, ওভেন ও কম্পোজিট ইউনিট—যেগুলোর নমুনা আকারকে প্রতিনিধিত্বমূলক ধরা হয়েছে। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক শ্রম সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান, শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুস সামাদ আল আজাদ এবং সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এ কে এম নাসিম।

অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, যেসব কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন বা সংগঠন সক্রিয় রয়েছে, সেখানে বর্ধিত মজুরি বাস্তবায়নের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে নতুন কাঠামো কার্যকরের পরও বেশ কিছু সমস্যা থেকে গেছে। গবেষণায় দেখা যায়, ৩১ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন তারা অতিরিক্ত কাজের (ওভারটাইম) বেতন ১ থেকে ১০ মাস পর্যন্ত বিলম্বে পেয়েছেন। ৫২ শতাংশ শ্রমিক কাজের চাপ ও উৎপাদন টার্গেট বৃদ্ধিকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ২২ শতাংশ শ্রমিক চাকরির অনিশ্চয়তা, ১৪ শতাংশ অনিয়মিত বেতন প্রদান এবং ১১ শতাংশ গ্রেড নির্ধারণ বা পদোন্নতি সংক্রান্ত বিভ্রান্তির কথা জানিয়েছেন।

গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, ১৪ শতাংশ শ্রমিক ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর ৯ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট সম্পর্কে জানতেন না। অন্যদিকে দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে এটি বাস্তবায়িত হয়েছে, তবে ১৩ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন তারা এখনো সেই ইনক্রিমেন্ট পাননি।

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান এই গবেষণায় উল্লিখিত ১৩ শতাংশ কারখানায় মজুরি অনিয়মের বিষয়ে মন্তব্য থেকে বিরত থাকেন। তার বক্তব্য, গবেষণায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলো বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ সদস্য কি না। তিনি দাবি করেন, রপ্তানিমুখী কারখানার শ্রমিকরা বর্তমানে মাস শেষে গড়ে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পাচ্ছেন। তার মতে, প্রতি পাঁচ বছর পর বড় পরিসরে মজুরি বৃদ্ধির পরিবর্তে প্রতিবছর মজুরি পুনর্বিবেচনার ব্যবস্থা করা হলে শ্রমিক আন্দোলন ও উৎপাদনে বিঘ্ন কমবে।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তাদের কোনো সদস্য কারখানাই বর্ধিত মজুরি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়নি, যদিও কিছু কারখানা হয়তো আংশিকভাবে বাস্তবায়ন করেছে। তিনি মনে করেন, যেসব কারখানা সদস্যভুক্ত নয়, সেগুলোর মজুরি বাস্তবায়ন, নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয় তদারকি করা সরকারের দায়িত্ব।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশ প্রোগ্রাম ম্যানেজার নীরান রামজুথন বলেন, ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নে অনিয়ম একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। তার মতে, সময়মতো ও পূর্ণ বেতন প্রদান শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার—যা শুধু তাদের জীবিকার জন্য নয়, বরং দেশের অর্থনীতি ও শিল্প খাতের সুনামের জন্যও অপরিহার্য। তিনি বলেন, যেখানে অনিয়ম হচ্ছে সেখানে পরিদর্শন ও তদারকি জোরদার করতে হবে, এবং এর ফলাফল প্রকাশ্যে আনতে হবে। একইসঙ্গে, ক্রেতাদেরও দায়িত্বশীল ক্রয়নীতি অনুসরণ করতে হবে, যেন ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন ব্যাহত না হয়।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার বলেন, মজুরি গেজেটে স্পষ্ট নির্দেশনার অভাবে অনেক মালিক নিজের মতো করে গ্রেড নির্ধারণ করছেন, যার ফলে শ্রমিকরা বৈধ মজুরি বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ছোট কারখানাগুলো ব্যবসা থেকে সরে যাচ্ছে, কিন্তু বড় কারখানাগুলো সম্প্রসারণ করছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে উৎপাদন এবং বার্ষিক রপ্তানি আয় উভয়ই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই গবেষণা সামগ্রিকভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, তৈরি পোশাক খাতে মজুরি কাঠামোর সংস্কার শুরু হলেও এর বাস্তবায়নে এখনও সমন্বয়, নজরদারি ও জবাবদিহিতা বাড়ানো প্রয়োজন। অন্যথায় খাতটির টেকসই উন্নয়ন এবং শ্রমিক কল্যাণ দুটোই ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাবে।
অকা/তৈপোশি/ই/সকাল/২৭ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 1 day আগে

Leave A Reply

Exit mobile version