অর্থকাগজ প্রতিবেদন

কম জনবল, কম সময়, কিন্তু আউটপুট বা ফলাফল আরও ভালো—এভাবেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি), আইটি-এনাবলড সার্ভিসেস (আইটিইএস), বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) খাত এবং ফ্রিল্যান্সারদের কাজে এক আমূল পরিবর্তন আনছে। দ্রুত এআই গ্রহণের ফলে দেশের তরুণ কর্মশক্তি দক্ষতার ঘাটতি কাটিয়ে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নিজেদের উপস্থিতি শক্ত করছে।

এআই-এর সুফল দৃশ্যমান

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এআই-এর ইতিবাচক প্রভাব দেখতে শুরু করেছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই আউটসোর্সিং রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৯০ কোটি ডলার, যা ২০২৪ সালের পুরো বছরের ৮৫ কোটি ডলার আয়ের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্টাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্কো)-এর সভাপতি তানভীর ইব্রাহিম এ তথ্য জানিয়ে বলেন, “এআই আমাদের দক্ষতার ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে আশীর্বাদস্বরূপ। ফলে অর্ডারও বেড়েছে।”

একসময় যেখানে মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন খাতে ১,০০০ দক্ষ কর্মী তৈরি করতে এক দশক লাগত, সেখানে এখন এআই ব্যবহারে প্রতিবছরই ১,০০০ নতুন কর্মী গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে। কোডিংয়েও বড় পরিবর্তন এসেছে। আগে কম্পিউটার সায়েন্স গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতার ঘাটতির কারণে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন ছিল। বর্তমানে ৭৫ শতাংশ কোডিংয়ের কাজ করছে এআই, বাকি ২৫ শতাংশ করছে মানব কর্মী। এতে সময় ও খরচ দুটোই কমেছে।

সাফল্যের গল্প: কো কোম্পানি

এআই-নির্ভর কাজের সুফল সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যায় কো (KOW) কোম্পানির সাফল্যে। করোনাভাইরাস মহামারির সময় ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই এআই-এ বিনিয়োগ করে। ফলে এখন কোম্পানির ৩০–৪০ শতাংশ ইমেজিংয়ের কাজ করে এআই। আগে যেখানে একটি থ্রিডি ডিজাইন তৈরি করতে ছয় ঘণ্টা লাগত, এখন মাত্র এক ঘণ্টায় তা শেষ হচ্ছে। ফলে কম জনবল দিয়েই প্রতিষ্ঠানটি দ্রুতগতিতে বেড়ে উঠেছে। বর্তমানে ৬০০ কর্মীর প্রতিষ্ঠানটি ই-কমার্স, রিটেইল, পোশাক, অটোমোটিভ, খাদ্য ও আবাসন খাতে সেবা দিচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ২০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, আর এ বছর তা ৩৫ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করছে কোম্পানি।

অগমেডিক্সের এআই অভিজ্ঞতা

অগমেডিক্স বিডি লিমিটেডও এআই-চালিত রূপান্তরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী রাশেদ নোমান জানান, এআই টুলস ব্যবহারের ফলে তাদের কাজের মান ও দক্ষতা উভয়ই বেড়েছে। শুধুমাত্র জুলাই মাসেই তারা ৪০ জন নতুন ডেটা অ্যানালিস্ট নিয়োগ দিয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন ১,৩০০ কর্মী, আর মাসিক কাজের অর্ডার দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ডলারেরও বেশি।

ফ্রিল্যান্সারদের ভ্যালু চেইনে উত্থান

একসময় কম দক্ষতা ও স্বল্প পারিশ্রমিকের কাজের ওপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক ফ্রিল্যান্সার। তবে এখন এআই টুলস হাতে থাকায় তারা ভ্যালু চেইনের উপরের স্তরে উঠছেন। শুধু ডেটা এন্ট্রি নয়, বরং বাজার বিশ্লেষণ, কনটেন্ট রাইটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং, থ্রিডি মডেলিংয়ের মতো কাজেও নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করছেন। ফলে তাদের আয়ের পরিমাণও বাড়ছে।

ঢাকার ফ্রিল্যান্সার সাইফুল ইসলাম একসময় ডেটা এন্ট্রির কাজ করতেন। এখন তিনি এআই ব্যবহার করে বাজার বিশ্লেষণ ও নতুন দক্ষতা চিহ্নিত করে উন্নতমানের কাজ করছেন। অপরদিকে আশিক মাহমুদ সাংবাদিকতা থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসার পর এআই-এর সহায়তায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ডিউ ডিলিজেন্স ও কনটেন্ট রাইটিং সেবা দিচ্ছেন।

বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা ও বাংলাদেশের অবস্থান

বাংলাদেশ এ বছরই প্রথমবারের মতো বিপিও ও আইটিইএস থেকে ১০০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি আয় করতে যাচ্ছে। তবে প্রতিবেশী ভারত ও ফিলিপাইনের তুলনায় তা এখনো নগণ্য। ভারতের এই খাতে রপ্তানি আয় প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলার এবং ফিলিপাইনের আয় সাড়ে ৭ হাজার কোটি ডলার।

বাক্কো’র তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪৫০টি বিপিও কোম্পানিতে ৯০ হাজার মানুষ কাজ করছেন। এছাড়া ফ্রিল্যান্সিংয়ে সক্রিয় আছেন আরও প্রায় সাড়ে ৬ লাখ তরুণ। নতুন কোম্পানি যুক্ত হওয়ায় এবং আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রপ্তানি আয়ের প্রবাহ বাড়লে আগামীতে এ খাত থেকে দ্বিগুণ আয় সম্ভব বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

এআই ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ

যদিও এআই নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচন করেছে, তবুও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

  • উচ্চ ব্যয়: চ্যাটজিপিটি, অ্যাডোব ফায়ারফ্লাই কিংবা প্রফেশনাল এডিটিং সফটওয়্যারের মাসিক খরচ ২০–১০০ ডলার, যা অনিয়মিত আয়ের ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ব্যয়বহুল। ফলে অনেকেই সীমিত সুবিধাযুক্ত ফ্রি বা ট্রায়াল ভার্সনে নির্ভর করেন।

  • ক্লায়েন্ট প্রত্যাশা: বিদেশি ক্লায়েন্টরা মনে করেন এআই ব্যবহার মানেই কম খরচে দ্রুত কাজ। কিন্তু ফ্রিল্যান্সারদের যুক্তি, মানবিক সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও যাচাইয়ের গুরুত্ব অগ্রাহ্য করা হচ্ছে।

  • ডিজিটাল সাক্ষরতার ঘাটতি: তরুণরা দ্রুত শিখলেও অনেক ফ্রিল্যান্সার এখনো উন্নত সফটওয়্যার, ক্লাউড-ভিত্তিক কাজ কিংবা প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিছিয়ে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও শিল্প বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের বিপিও ও ফ্রিল্যান্সিং খাত এখনো এআই-চালিত রূপান্তরের প্রাথমিক ধাপে রয়েছে। বৈশ্বিক বাজারে ডেটা অ্যানালিটিকস, স্বাস্থ্যসেবা সহায়তা, ক্রিয়েটিভ ডিজাইন ও বহুভাষী কনটেন্ট সেবার চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বিশেষায়িত ও উচ্চমূল্যের খাতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারবে।
অকা/তপ্র/ই/সকাল/২৪ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 4 weeks আগে

Leave A Reply

Exit mobile version