অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

বাংলাদেশের ব্যাংক–বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) এখন চরম সংকটে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও সরকারি দলের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের প্রভাব কাজে লাগিয়ে গত এক দশকে অনেক প্রতিষ্ঠান জামানত ছাড়াই ঋণ বিতরণ করেছে। এসব ঋণের বড় অংশ এখন আর আদায়যোগ্য নয়। অনেক ঋণগ্রহীতাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আবার কারও কাছে আদায় করার মতো সম্পদ নেই। ফলে খেলাপি ঋণের বোঝা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে খাতটিকে ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে গেছে। এর প্রভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না, আর পুরো খাতের প্রতি আস্থা দ্রুত নষ্ট হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে এনবিএফআই খাতে মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৭ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। মাত্র এক বছর আগে, ২০২৪ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনবিএফআই সংকটের মূল শেকড় রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়ম ও দুর্নীতি। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় পরিচালনা পর্ষদে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের ঘনিষ্ঠদের নামে ঋণ অনুমোদন করেছেন, যার বড় অংশই জামানতবিহীন। এর একটি বড় উদাহরণ পি কে হালদারের দুর্নীতি। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যত ধ্বংসের মুখে পৌঁছেছে। পিপলস লিজিংয়ের প্রায় সব ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হার ৯৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শুধু এ প্রতিষ্ঠানই নয়—ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফিন্যান্স ও আভিভা ফিন্যান্সসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশে পৌঁছেছে। সব মিলিয়ে খাতটি এখন প্রায় দেউলিয়া অবস্থায়।

অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, এনবিএফআই খাতের এই সংকট দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়মতো কঠোর ব্যবস্থা না নিলে একের পর এক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে পড়বে এবং সাধারণ আমানতকারীরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ হারানোর আশঙ্কায় পড়বেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সংকট নিরসনে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। উচ্চ খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি ও আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে অক্ষমতা—এই তিন সূচক বিবেচনায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ‘অব্যবহারযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—

  • পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস

  • ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস

  • আভিভা ফাইন্যান্স

  • এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট

  • ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট

  • বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)

  • প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স

  • জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি

  • প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধে সরকারের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়াকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেজল্যুশন ডিপার্টমেন্ট ইতোমধ্যে গভর্নরের অনুমোদন নিয়ে অবসায়ন প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। অবসায়নের সময় ক্ষুদ্র আমানতকারীরা যেন তাদের জমা অর্থ ফেরত পান, তা নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি বর্তমান কর্মীদের চাকরিবিধি অনুযায়ী সব সুযোগ–সুবিধা দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।

উল্লেখ্য, দেশে প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮১ সালে আইপিডিসির মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্স দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুমতি দেয় এবং ১৯৯৪ সালের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে দেশে মোট ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণ ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের ৮৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। বিপরীতে এসব ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ঋণের মাত্র ২৬ শতাংশ। অন্যদিকে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা ১৫টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে, এর মধ্যে ৫টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশেরও নিচে রয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, আর্থিক খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে এনবিএফআই খাতের প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি। অন্যথায় এর নেতিবাচক প্রভাব ব্যাংক খাতসহ পুরো অর্থনীতির ওপর পড়বে। এজন্য অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই হতে পারে সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ।
অকা/আখা/ই/সকাল/২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে

Leave A Reply

Exit mobile version