অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
দীর্ঘ দেড় যুগের অনিয়ম ও অব্যবস্থায় প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া পুঁজি বাজারে এক বছরের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা সংস্কারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে পারছে না। দেশের শিল্প ও সেবা খাতের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অর্থায়নের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত এ খাতটি এ মুহূর্তে কিছু দ্রুত মুনাফালোভী মানুষের টাকা বানানোর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ফলে এখানে বিনিয়োগকারী, দেশী বা বিদেশী কেউই এ পুঁজি বাজারের সুফল পাচ্ছেন না।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পুঁজি বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠিত হওয়ার পর থেকে সংস্থাটির পক্ষ থেকে পুঁজি বাজার সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। এটা করতে গিয়ে শুরুর দিকে সংস্থাটি নিজস্ব জনবল নিয়ে সঙ্কটের মুখে পড়ে। কারণ এর আগে দীর্ঘদিন সংস্থাটির অভ্যন্তরে একটি গ্রুপ বাজার ধ্বংসকারী একটি সিন্ডিকেটের সাথে সক্রিয় ছিল যারা নতুন কমিশনের নেয়া বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমে বাধা তৈরি করছিল। এতে কয়েক সপ্তাহের জন্য অচল হয়ে পড়ে সংস্থাটি। পরবর্তীতে গ্রুপের পালের গোদাকে অব্যাহতির পাশাপাশি বেশ কয়েকজনকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। নতুন কমিশনের প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্র্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রত্যক্ষ সমর্থনের কারণে উদ্ভুত সঙ্কট থেকে মুক্তি পায় বিএসইসি। পরবর্তীতে সংস্কারকে এগিয়ে নিতে গিয়েও তখনকার বাজার পরিস্থিতি নতুন করে সঙ্কটের মুখে ফেলে কমিশনকে।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাৎক্ষণিকভাবে বাজার পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সেখানে যুক্তির চেয়ে আবেগই কার্যকর ছিল বেশি। তারই ফলে মাত্র চার কর্মদিবসের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচকটির উন্নতি ঘটে প্রায় হাজার পয়েন্ট। একই সময় ২০০ কোটি টাকার লেনদেন পৌঁছে যায় দুই হাজার কোটির ওপরে। বিনিয়োগকারীদের এ আবেগ কিন্তু বেশি দিন টেকেনি। ৪ আগস্ট ডিএসই’র প্রধান সূচকটি অবস্থান করছিল পাঁচ হাজার ২২৯ দশমিক ২৬ পয়েন্টে। আর ১১ আগস্ট তা পৌঁছে যায় ছয় হাজার ১৫ দশমিক ৯০ পয়েন্টে। আর এই চার কর্মদিবসে বাজারটিতে ২০৭ কোটি টাকার লেনদেন পৌঁছে যায় দুই হাজার ১০ কোটি টাকায়। কিন্তু এর পরপরই বাজারে শুরু হয় নেতিবাচক প্রবণতা।

পরবর্তীতে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এসে নতুন কমিশন গঠিত হয়। নতুন কমিশন দীর্ঘদিনের এ অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার মধ্যে নিজেদের খেই হারিয়ে ফেলে যা প্রভাব পড়ে বাজারে। পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের উত্তরণ ঘটিয়ে বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে বেশ কিছু সময় ব্যয় হয়। ওই সময়ের মধ্যেও অতীতের বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছু কিছু শাস্তির উদ্যোগ নেয়ায় পুঁজি বাজারের স্টেক হোল্ডারদের একটি বড় অংশ কমিশনের সাথে অসহযোগিতার মনোভাব দেখায় যা সংস্কারের কাজকে আবার বাধাগ্রস্ত করে। একই সময় ধারাবাহিক পতনের মুখে পড়ে যায় দেশের দুই পুঁজি বাজার। বিনিয়োগকারীরা দিনের পর দিন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ ধারণ করলে সঙ্কট নিরসনে এগিয়ে আসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে এ উদ্যোগে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ পুঁজি বাজার সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের একটি বড় অংশ বৈঠকে উপস্থিত থেকে সঙ্কট উত্তরণে কার্যকর বেশ কিছু পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। এসব পরামর্শের আলোকে প্রধান উপদেষ্টা সাতটি নির্দেশনা দেন। এ পর্যায়ে প্রধান তিনি সংক্রান্ত বিষয় তদারকির জন্য নতুন সহকারী নিয়োগ দেন যেটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রমে কিছুটা হলেও গতি ফিরিয়ে আনে। আর প্রধান উপদেষ্টার নেয়া উদ্যোগে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার হয় যা সাময়িকভাবে বাজার পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি ঘটায়।

১১ মে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু তারপরও বাজার ইতিবাচক ধারায় ফিরতে আরো কিছু সময় নেয়। ২৮ মে ডিএসই সূচক নেমে আসে সাম্প্রতিক সময়ের সর্বনিম্ন অবস্থান চার হাজার ৬১৫ পয়েন্টে। তবে জুন মাসের শুরু থেকে উন্নতি ঘটে বাজার পরিস্থিতির। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৮ সেপ্টেম্বর ডিএসই সূচকটি সাম্প্রতিক সময়ের সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ৬৩৬ দশমিক ১৫ পয়েন্টে এবং অনুরূপভাবে বাজারটির লেনদেন পৌঁছে যায় এক হাজার ৪৪০ কোটি টাকায়।

এদিকে নানা কাটখড় পুড়িয়ে বাজারগুলো ইতিবাচক ধারায় ফেরার শুরুতে বাজার আচরণ স্বাভাবিক থাকলেও দীর্ঘদিন ঘাপটি মেরে থাকা বাজার খেলোয়াড়রা আবার কারসাজিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আবার স্বাভাবিকতা হারাতে থাকে বাজার। এখনকার পুঁজি বাজারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ স্বল্প মূলধনের কোম্পানিগুলো। কোনো কারণ ছাড়াই মৌল ভিত্তির দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা এসব কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিই এ সঙ্কট তৈরি করেছে। দ্রুত মুুনাফালোভী ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ কোম্পানিগুলোর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে মুনাফা লুটে নিচ্ছে যা দীর্ঘদিন ধরে মন্দায় আটকে থাকা বাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের আবার হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য করছে। যেখানে বাজারের মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত দরপতনের শিকার হচ্ছে সেখানে এসব স্বল্প মূলধনের কোম্পানির দৌরাত্ম্য বিনিয়োগকারীদের বাজার বিমুখ করে তুলছে। যদিও এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা পুঁজি বাজার কর্তৃপক্ষের কোনো আইনগত সুযোগ নেই তবুও এ অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে বিনিয়োগকারীদের বাজারমুখো করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও পুঁজি বাজার কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি মনে করছেন পুঁজি বাজারসংশ্লিষ্টরা। ●

অকা/পুঁবা/ফর/রাত/৩ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 8 hours আগে

Leave A Reply

Exit mobile version