অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সাম্প্রতিক মাশুল বৃদ্ধির ঘোষণাটি দেশের ব্যবসায়িক মহলে তীব্র আলোড়ন তুলেছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৯৮৬ সালের পর এই প্রথমবার ট্যারিফ পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে—এ যেন অনেকটা সময়োচিত সমন্বয়। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এটি কেবল ‘সমন্বয়’ নয়; বরং এক জটিল প্রভাবের ফল, যেখানে সরকারি সিদ্ধান্তের পেছনে বিদেশি উপদেষ্টাদের প্রভাব, স্বার্থসংঘাত এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতার মিশ্রণ কাজ করছে।
১৯৮৬ সালে যখন বন্দরের ট্যারিফ সর্বশেষ নির্ধারিত হয়, তখন এক ডলারের মান ছিল মাত্র ২৭ টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২২ টাকায়। অর্থাৎ চার দশকে ট্যারিফ না বাড়িয়েও বন্দরের টাকায় আয় বাস্তবে চারগুণ বেড়েছে। তবু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২,৯১৩ কোটি টাকার রেকর্ড মুনাফার পরও কেন হঠাৎ এই মাশুল বাড়ানো হলো—এই প্রশ্নই এখন আলোচনার কেন্দ্রে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, দীর্ঘদিনের স্থবির কাঠামো হালনাগাদ করা হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও আধুনিকায়নের প্রয়োজনে। কিন্তু প্রাপ্ত নথি বলছে, নতুন ট্যারিফ কাঠামোটি বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি শাখা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)–এর প্রস্তাবিত মডেলের সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যায়। এই আইএফসি-ই আবার পতেঙ্গা ও লালদিয়া টার্মিনালের কনসেশন চুক্তির পরামর্শদাতা, যেখানে বিদেশি অপারেটরদের জন্য বাজার “বিনিয়োগবান্ধব” করে তোলাই ছিল মূল লক্ষ্য।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখানেই তৈরি হয়েছে মূল স্বার্থসংঘাত। আইএফসি একদিকে সরকারের পরামর্শদাতা, অন্যদিকে বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের সম্ভাব্য অর্থায়নকারী। যেমন, সিঙ্গাপুরের বন্দর অপারেটর পিএসএ যে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের বে টার্মিনাল প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে, সেটিতেও আইএফসি অর্থায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অর্থাৎ, যারা নীতিনির্ধারণ করছে, তারাই বিনিয়োগকারী হিসেবে লাভবান হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান এম. শাহজাহান বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করে বলেন, “যদি একই প্রতিষ্ঠান সরকারকে নীতিগত পরামর্শ দেয় এবং বিনিয়োগেও অংশ নেয়, তবে এটি নীতিগত নিরপেক্ষতা নষ্ট করে।” অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ আরও স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “এটি এক ধরনের নরম বাণিজ্যিক উপনিবেশ—যেখানে সিদ্ধান্ত সরকারের নয়, পরামর্শদাতার কলমেই লেখা হয়।”
২০২৪ সালের জুনে বিশ্বব্যাংক বে টার্মিনালের জন্য ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন দেয়। সেই বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল—আইএফসি একই প্রকল্পে সরাসরি বিনিয়োগ বিবেচনা করছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, আইএফসি কি নীতিনির্ধারণের মুখোশে বন্দর অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তারের নতুন কৌশল নিয়েছে?
আইএফসি অবশ্য দাবি করেছে, তারা সরকারের স্বার্থে কাজ করে এবং “অপারেশনাল কনফ্লিক্ট নীতি” অনুসারে বিনিয়োগ ও পরামর্শদাতা দল আলাদা রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই নীতিগুলোর প্রয়োগ কতটা কার্যকর, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
ট্যারিফ বৃদ্ধির বিশ্লেষণে দেখা যায়, কনটেইনার হ্যান্ডলিং, ক্রেন অপারেশন, রিফার প্লাগ-ইনসহ যেসব সেবায় বেসরকারি অপারেটরদের সরাসরি লাভ, সেসব খাতেই বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি—গড়ে ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০ ফুট রিফার কনটেইনারের প্লাগ-ইন চার্জ ৯ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় ২১ ডলার।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবে তাদের ব্যয় আরও বাড়াবে। ২০২০ সালে যখন এক ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, তখন ৪৩ ডলারের হ্যান্ডলিং ফি ছিল ৩,৬৫৫ টাকা। এখন ডলার ১২৪ টাকায় দাঁড়ানোয় একই ফি হয়ে গেছে ৫,৩৩২ টাকা—অর্থাৎ ৪৫ শতাংশ বেশি। তার ওপর আবার নতুন ট্যারিফের বোঝা।
র্যাপিড চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক মনে করেন, “বন্দর ট্যারিফ বাড়ানো একেবারে অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু এটি ধাপে ধাপে করা উচিত ছিল। একবারে এতটা বৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।”
অন্যদিকে বন্দর কর্তৃপক্ষের যুক্তি, চার দশক পর এই সমন্বয় না করলে ভবিষ্যতের বড় বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অর্থের ঘাটতি তৈরি হতো। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের আসল সংকট ট্যারিফ নয়, বরং দক্ষতা, জট ও স্বচ্ছতার অভাব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি জাহাজের টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম যেখানে ২৪ ঘণ্টার কম, সেখানে চট্টগ্রামে লাগে ৫ থেকে ৭ দিন—যা ব্যবসায়ীদের প্রকৃত খরচ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
সব মিলিয়ে এই ট্যারিফ বৃদ্ধি কেবল মাশুলের বিষয় নয়; এটি বাংলাদেশের বন্দরনীতি, বিদেশি প্রভাব ও অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি প্রমাণ করবে—বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন কি সত্যিই জাতীয় প্রয়োজনে হচ্ছে, নাকি বিদেশি বিনিয়োগের শর্তে গড়ে উঠছে এক নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতা। ●
অকা/রা/ই/সকাল/৯ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 5 days আগে