অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া, নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও টার্মিনালের পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তর করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, লালদিয়া টার্মিনাল ৩০ বছরের জন্য এবং বাকি দুটি টার্মিনাল ২৫ বছরের জন্য বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়া হবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের একটি সেমিনারে জানান, সরকার ২০২০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য বিদেশি কনসালটেন্ট নিয়োগ করে। তাদের প্রতিবেদন সম্প্রতি সরকারের হাতে এসেছে এবং সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই বন্দরের ট্যারিফ কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি শাখা, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), পতেঙ্গা ও লালদিয়া টার্মিনালের কনসেশন চুক্তি তৈরিতে সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছে। আইএফসি তাদের প্রতিবেদনে সতর্ক করে জানিয়েছিল, বাংলাদেশের অপরিবর্তনীয় ট্যারিফ নীতি আন্তর্জাতিক অপারেটরদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে পারে। তাই তারা নিশ্চিত ট্যারিফ সংস্কার এবং নিয়মিত হার বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিল। সরকার এই পরামর্শকে বাস্তবায়ন করে সাম্প্রতিক ট্যারিফ বৃদ্ধি করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৮৬ সালের পর প্রথমবার এই ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে বাস্তব চিত্র দেখায়, টাকার মান ডলারের বিপরীতে কমে যাওয়ায় বন্দরের আয় ইতিমধ্যেই বহু গুণ বেড়ে গেছে। অর্থাৎ, নতুন ট্যারিফ শুধুমাত্র মুদ্রাস্ফীতির সমন্বয় নয়, বরং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাজারকে আর্থিকভাবে আকর্ষণীয় করার কৌশলও বটে।
এতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে নতুন বিদেশি অপারেটররা। ইতিমধ্যেই সৌদি আরবভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনা করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড শিগগিরই এনসিটি নিয়ন্ত্রণে নেবে, যা বন্দরের মোট কনটেইনার পরিবহনের প্রায় ৪০ শতাংশ পরিচালনা করবে। ডেনমার্কের এ.পি. মোলার মায়েরস্কও লালদিয়া টার্মিনাল কনসেশনে আগ্রহী।
সমালোচকরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ বাড়লেও এর সঙ্গে সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব ভাগাভাগির ঝুঁকি যুক্ত। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে বিদেশি প্রতিষ্ঠান প্রথমে বিনিয়োগ ফেরত নিয়ে পরে বিপুল মুনাফা অর্জন করবে, যা রাষ্ট্রীয় রাজস্বে সীমিত প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি, ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে আমদানি খরচ বেড়ে যেতে পারে, যা ভোক্তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে।
সরকারের যুক্তি, বিদেশি অপারেটর আনা হলে বন্দর ব্যবস্থাপনা আধুনিক, দ্রুত এবং দক্ষ হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসের সময় বেশি, যা ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত ব্যয় তৈরি করছে। উন্নত প্রযুক্তি ও অটোমেশন ব্যবহার করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এই সময় কমিয়ে আনবে, ফলে রফতানি ও আমদানি খরচও কমবে।
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। দেশীয় আমদানি-রফতানির প্রায় ৯০ শতাংশ এখান দিয়ে হয়। তাই বন্দরের বিদেশি অপারেটরের কাছে হস্তান্তর শুধুই প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়; এটি দেশের সমুদ্রবাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। একদিকে সম্ভাবনা—দক্ষতা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, অন্যদিকে ঝুঁকি—নিয়ন্ত্রণ ও নীতিগত ভারসাম্য হারানো।
মূল প্রশ্নটি এখন কৌশলগত: বাংলাদেশ কি বন্দর দক্ষতা বাড়ানোর বিনিময়ে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ আংশিকভাবে ছাড়তে প্রস্তুত? এই সিদ্ধান্তই আগামী দশকে বাংলাদেশের সমুদ্রবাণিজ্যের দিক নির্ধারণ করবে—বৈশ্বিক সংযুক্তি নাকি নির্ভরতার ফাঁদে পতন। ●
অকা/প্র/ই/সকাল/১৩ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 19 hours আগে