অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
চামড়া শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি সম্ভাবনাময় খাত, যা প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই খাত মারাত্মক ঋণ সংকটে পড়েছে। ঋণ পরিশোধে গাফিলতি এবং ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে শিল্পের অগ্রযাত্রায় দেখা দিয়েছে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চামড়া খাতে ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রায় ৩৮.৪ শতাংশ, খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অর্থাৎ, চামড়া শিল্পে খেলাপির হার সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের গড়ের তুলনায় অনেক বেশি, যা ব্যাংকগুলোকে নতুন করে এই খাতে ঋণ প্রদানে নিরুৎসাহিত করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চামড়া খাতে পুনঃতফসিল করা ঋণের অনাদায়ী অংশ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকায়। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যবসায়ী এমনকি ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে এই পুনঃতফসিলের সুযোগও গ্রহণ করছেন না। জনতা ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনেক ট্যানারি মালিক ঋণ পুনঃতফসিলে অনীহা প্রকাশ করছেন, যদিও ব্যাংকগুলো থেকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের বিতরণকৃত চামড়া খাতভিত্তিক ঋণের ৪০ শতাংশের বেশি বর্তমানে খেলাপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “ব্যবসায়ীরা যদি নেয়া ঋণ ফেরত না দেন, তাহলে ব্যাংক কীভাবে আবার ঋণ দেবে? ঋণ নিতে হলে ফেরত দেওয়ার মানসিকতা থাকা জরুরি। নতুবা এই সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়।”
চলতি বছরের কোরবানির ঈদ সামনে রেখে ব্যাংকগুলো চামড়া ক্রয়ের জন্য মাত্র ১২৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে, যদিও অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল ২৩২ কোটি টাকা। অথচ বিগত বছরগুলোতে এই ঋণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২০২৪ সালে ২৭০ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে ২৫৯ কোটি টাকা, ২০২২ সালে ৪৪৩ কোটি টাকা, ২০২১ সালে ৬১০ কোটি টাকা, ২০২০ সালে ৭৩৫ কোটি টাকা এবং ২০১৯ সালে ১,৮০০ কোটি টাকা। এই ধারাবাহিক পতন চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করছে, বিশেষ করে ঈদ-উল-আযহার সময়, যখন দেশের মোট বার্ষিক কাঁচা চামড়ার প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ সংগ্রহ হয়।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ জানান, চামড়া একটি পচনশীল পণ্য। তাই দ্রুত নগদ অর্থে ক্রয় ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। এবারে আমাদের ৩০০-৩৫০ কোটি টাকার চাহিদা থাকলেও মাত্র ১২৫ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে, যা কার্যত অপ্রতুল। বিটিএর তথ্য অনুযায়ী, সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮০০, যার মধ্যে ট্যানারি মালিক ও রফতানিকারক উভয়ই রয়েছেন। সারা দেশে রয়েছে প্রায় ১,৮৬৬টি বড় ও মাঝারি আড়ত, এবং আরও হাজারো ছোট ব্যবসায়ী ঈদকেন্দ্রিক চামড়া সংগ্রহে জড়িত।
আড়তদার নূর ইসলাম বলেন, ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতি বছর প্রায় ৩০ শতাংশ কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়, যার কারণে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত দরিদ্র জনগোষ্ঠী আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। চামড়া ব্যবসায়ী আজম মিয়া অভিযোগ করেন, ব্যাংকগুলো শুধু ট্যানারি মালিক বা রফতানিকারকদের ঋণ দেয়, কিন্তু আড়তদার ও কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারীরা ঋণ থেকে বঞ্চিত। অথচ চাহিদা অনুযায়ী অর্থ পেলে চামড়া নষ্ট ঠেকানো যেত।
চামড়া সংরক্ষণে সহায়তা দিতে সরকার এবার ঈদ উপলক্ষে এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৩০ হাজার টন লবণ বিনামূল্যে সরবরাহ করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দামে ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার মূল্য প্রতি বর্গফুট ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, এবং ঢাকার বাইরে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। খাসি ও বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ২২-২৭ টাকা ও ২০-২২ টাকা প্রতি বর্গফুট। ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারিত হয়েছে ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা।
চামড়া শিল্পে ঋণ খেলাপির ঊর্ধ্বগতি শুধু ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে না, বরং সামগ্রিক শিল্পের প্রবৃদ্ধিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। খেলাপির হার কমাতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণ পরিশোধের নৈতিকতা ও বাধ্যবাধকতা জোরদার করা জরুরি। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকিনির্ভর হলেও খাতটির মৌসুমি চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে ঋণ বিতরণে আরও কার্যকর ও লক্ষ্যভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো যদি যৌথভাবে কার্যকর পরিকল্পনা নেয়, তাহলে এই সম্ভাবনাময় শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। অন্যথায়, চামড়া শিল্পে অনিয়ম ও সংকট আরও গভীর হবে, যা অর্থনীতির এক সম্ভাবনাময় খাতকে অন্ধকারে ঠেলে দেবে। ●
অকা/প্র/ই/সকাল/১২ জুন, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 months আগে

