অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশ আজ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও, সেই উৎপাদনের প্রাণভিত্তি—বীজ—নিয়ে দেশটি ক্রমেই হয়ে পড়ছে আমদানিনির্ভর। ধান থেকে ভুট্টা, পাট থেকে সবজি—প্রায় সব ফসলের ক্ষেত্রেই বিদেশি বীজ এখন দেশের কৃষি ব্যবস্থার নীরব নিয়ামক।
দুই দশক আগেও দেশের বীজের বড় অংশই আসত কৃষকের নিজস্ব সংরক্ষণ বা সরকারি সংস্থা বিএডিসি থেকে। তখন বীজ সংরক্ষণ ছিল গ্রামীণ কৃষি সংস্কৃতির অংশ। এখন সেই ঐতিহ্য প্রায় হারিয়ে গিয়ে জায়গা নিচ্ছে বিদেশি বীজ।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা তখনই টেকসই হবে, যখন বাংলাদেশ ‘বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণ’ হতে পারবে।
বীজ আমদানির ঊর্ধ্বগতি
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট বীজ চাহিদা ছিল প্রায় ১৩.১৪ লাখ টন। এর মধ্যে আলু ও ধানের বীজের বড় অংশ দেশীয়ভাবে উৎপাদিত হলেও, পাট, ভুট্টা, শাকসবজি, তৈলবীজ ও ডালের ক্ষেত্রে প্রধান উৎস এখন বিদেশ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী,
-
২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৩২,৩৮৫ টন বীজ,
-
২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৩৬,৪৯২ টন,
-
২০২২–২৩ অর্থবছরে ৩১,৬৯৪ টন।
কিছু মূল খাতের চিত্র—
-
পাটবীজ: বার্ষিক চাহিদা ৬,০০০–৬,৪০০ টন, যার ৭৫–৮০% আমদানিকৃত।
-
ভুট্টা: বছরে প্রয়োজন ১৫ হাজার টন, এর ৯০–৯৫% বিদেশ থেকে আসে।
-
সবজি: বছরে ৪,০০০–৪,৫০০ টন বীজ লাগে, যার প্রায় ৬০% আমদানি নির্ভর।
-
তৈলবীজ: চাহিদা ২৬,৯৪৭ টন, যার ৮৫–৯০% আমদানি করা হয়।
-
ডাল: ২৩,১২৭ টনের চাহিদার ৮০% আসে বিদেশ থেকে।
-
হাইব্রিড ধান: মোট চাহিদা ২৬ হাজার টন, এর প্রায় ২০% বিদেশি উৎস থেকে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সরবরাহ করে মোট চাহিদার প্রায় ৩৩%, বেসরকারি খাত দেয় ৩০%, আর কৃষকরা নিজেরা উৎপাদন করেন ৩৭%।
দেশীয় বীজ সরবরাহে এগিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে লাল তীর সিড, এসিআই সিড, সুপ্রিম সিড, ব্র্যাক সিড অ্যান্ড অ্যাগ্রো, ইস্পাহানি অ্যাগ্রো ও মেটাল অ্যাগ্রো।
পাটবীজে ভারতের ওপর নির্ভরতা
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট উৎপাদক, কিন্তু নিজের পাটবীজের যোগান দিতে পারছে না। বছরে ৬,০০০–৬,৪০০ টন চাহিদার মধ্যে ৪,০০০–৫,০০০ টন আসে ভারত থেকে।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) এখন পর্যন্ত ৫৭টি জাত উদ্ভাবন করেছে, তবে উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় কৃষকরা সেগুলোতে আগ্রহী নন। অধিকাংশ কৃষক এখনও ভারতীয় জেআরও ৫২৪ জাতের বীজ ব্যবহার করেন। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে শুধুমাত্র ভারত থেকেই ৪,১১৬ টন জেআরও ও কেনাফ বীজ আমদানি হয়েছে।
বিজেআরআইয়ের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক নার্গীস আখতার বলেন, “কৃষকরা ধান ও সবজি চাষে বেশি লাভ পান, তাই পাটবীজ উৎপাদনে আগ্রহ কম। বিএডিসি ও ডিএই-এর সঙ্গে সমন্বয় করলে আমরা পাটবীজে স্বনির্ভর হতে পারব।”
ভুট্টার সাফল্যের আড়ালে বিদেশি বীজ
গত এক দশকে বাংলাদেশের ভুট্টা উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। এখন বছরে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৭৩ লাখ টন, যেখানে ২০১৫–১৬ অর্থবছরে তা ছিল মাত্র ২৭.৬ লাখ টন।
তবে এই সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি বিদেশি বীজ। বছরে ১৫ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে ১৪,৮১৭ টন বীজ আমদানি হয়, যার ৮৫–৯০% ভারত থেকে এবং বাকিটা থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
সবজি, হাইব্রিড ধান ও তৈলবীজ: ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮০ লাখ টন সবজি উৎপাদিত হয়। কিন্তু উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের অধিকাংশ বীজ আসে বিদেশ থেকে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে সবজির বীজ আমদানি হয়েছে ১,৮০০ টন, আর শাকের বীজ ৮৫০ টন।
প্রধান আমদানিকৃত বীজের মধ্যে রয়েছে মুলা (১,১২৬ টন), ঢেঁড়স (৩৪১ টন), মরিচ (৯০ টন) ও করলা (৩৯ টন)। বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি ও বিটের মতো ফসলের বীজ প্রায় সম্পূর্ণই বিদেশি।
অন্যদিকে, হাইব্রিড ধান বর্তমানে মোট আবাদি জমির ১৬ শতাংশে চাষ হয়, যা উৎপাদনের ২১ শতাংশ দেয়। এর প্রায় ২০ শতাংশ বীজ সরাসরি আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. খালেকুজ্জামান জানান, “আমরা এখন পর্যন্ত আটটি হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করেছি, আরও দুটি অনুমোদনের অপেক্ষায়। বিএডিসি ও বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে সেগুলোর সম্প্রসারণের পরিকল্পনা চলছে।”
বীজ নিরাপত্তা ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা টেকসই নয়
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান সতর্ক করে বলেন, “খাদ্য উৎপাদনের মূল উপাদান হচ্ছে বীজ। এটি সময়মতো ও মানসম্মত না পেলে পুরো উৎপাদনব্যবস্থা ব্যাহত হয়। তাই খাদ্য নিরাপত্তার পরবর্তী ধাপ হলো বীজ নিরাপত্তা।”
তার মতে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু আমদানির ওপর নির্ভর না করে নিজস্ব গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করতে হবে। আর সরকারকে বিএডিসির সক্ষমতা বাড়াতে হবে—যাতে পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হয়।
বেসরকারি খাতের দাবি: সহায়তা ও নীতিগত সংস্কার
লাল তীর সিড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব আনাম বলেন, “বিদেশে পাটবীজ সস্তা কারণ তাদের উৎপাদন ব্যয় কম। বাংলাদেশে জমি ও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আবার বীজ ছাড়করণ প্রক্রিয়ায়ও জটিলতা আছে, যা সহজ করতে হবে।”
সুপ্রিম সিড কোম্পানির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাসুম মনে করেন, “সরকারি গবেষণার ফলাফল বেসরকারি খাতের জন্য উন্মুক্ত করা গেলে আমদানি নির্ভরতা কমবে। তবে এখনো হাইব্রিড সবজি বীজ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা কঠিন।”
এসিআই অ্যাগ্রিবিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফএইচ আনসারী বলেন, “দেশে স্থানীয়ভাবে হাইব্রিড বীজ উৎপাদন দ্রুত বাড়ছে। সরকারি–বেসরকারি যৌথ প্রচেষ্টায় কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারব।”
শেষকথা: খাদ্য নিরাপত্তার মূলে বীজ নিরাপত্তা
বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও, বীজে আমদানিনির্ভরতা সেই অর্জনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈদেশিক সম্পর্ক বা সরবরাহ ব্যাহত হলে পুরো কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাই বিপর্যস্ত হতে পারে।
তাই কৃষি বিশেষজ্ঞদের অভিমত—যতক্ষণ না বীজে স্বনির্ভরতা আসে, ততক্ষণ খাদ্য নিরাপত্তা কেবল পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ●
অকা/প্র/ই/সকাল/২৩ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 13 hours আগে