অর্থকাগজ ডেস্ক ●
অপরিশোধিত তেলের দাম একঝটকায় ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। অপরিশোধিত তেলের অন্যতম মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৭৫ দশমিক ১৫ ডলারে দাঁড়ায়, গত পাঁচ মাসে যা সর্বোচ্চ। অনেক ব্যবসায়ী ধরে নিচ্ছেন, ইসরায়েলের এই হামলা হয়তো একধাপে থেমে যাবে না। ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা আছে।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে কথার যুদ্ধেও পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, ‘এই হুমকি অর্থাৎ তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা দূর না হওয়া পর্যন্ত সামরিক অভিযান চলবে।’ অন্যদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘ইসরায়েলকে এই হামলার জন্য কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।’
স্বাভাবিকভাবেই ১৩ জুন এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ার বাজারে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খায় জার্মানির ডিএএক্স সূচক। ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ও নাসডাক সূচকেরও পতন হয়। বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ার ছেড়ে নিরাপদ সম্পদে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখেন। ফলে তরতর করে বাড়ছে সোনার দাম।
ইউরোপের ভ্রমণ ও বিনোদন খাত সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে, যদিও জ্বালানি ও প্রতিরা খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বেড়েছে। রাইনমেটাল ও বিএইইর মতো প্রতিরাশিল্পের শেয়ারদর ২ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
বিশ্ব বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে হামলার প্রভাব। বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি এড়িয়ে নিরাপদ মাধ্যমে বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছেন। তারা আরও বলেন, এই হামলা বড় পরিসরে সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা এখন প্রকট হয়ে উঠেছে।
ইসরায়েল ও ইরান নিজেদের আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে। ইরাক ও জর্ডান একই পদপে নিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইনস বা বিমান পরিচালন সংস্থা ওই অঞ্চলে উড়ান বাতিল করেছে। যুদ্ধের আশঙ্কায় বিমান ভূপাতিত হওয়ার ভয় আছে এ পরিস্থিতিতে ওই অঞ্চলে বিমান চলাচল কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।
বিমান নিরাপত্তা পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ওসপ্রে ফাইট সলিউশনস জানায়, ২০০১ সালের পর বিশ্বজুড়ে ভুলবশত ছয়টি বাণিজ্যিক বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। প্রায় একই সময়ে তিনটি বাণিজ্যিক বিমান অল্পের জন্য রা পেয়েছে। তবে বিমানের পথ পরিবর্তন করা ব্যয়সাপে। এতে যাত্রার সময় বাড়ে, প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত জ্বালানির।
ইরানের পাল্টা হামলার আশঙ্কায় ইসরায়েলি বিমান সংস্থাগুলো তাদের কিছু উড়োজাহাজ তেল আবিবের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে। ফাইট ট্র্যাকিংয়ের তথ্যানুসারে, শুক্রবার সকালে তেল আবিব থেকে বেশ কয়েকটি বিমান উড়াল দেয়। এর মধ্যে কিছু বিমান যাত্রী ছাড়াই সাইপ্রাস ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যায়।
১৩ জুন ইসরায়েল যখন ‘বিশেষ জরুরি অবস্থা’ জারির ঘোষণা দেয়, ততণে দেশটির মুদ্রা শেকেলের প্রায় ২ শতাংশ দরপতন ঘটে গেছে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মানুষ সুপারশপে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এমনকি এসব দোকানে পণ্যের তাকও খালি হয়ে যায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা যায়, অনেক জায়গাতেই খাবারদাবারের তাক খালি হয়ে গেছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট জানায়, সুপারমার্কেট চেইন ক্যারেফোরে এক দিনেই ৩০০ শতাংশ ক্রেতা বেড়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানি উৎপাদনকারী অঞ্চল। সেখানেই বিশ্বের বৃহত্তম তেলের মজুত। সৌদি আরব ও ইরাকের পর ইরান এই অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদক। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটি এখনো চীন ও ভারতকে বিপুল পরিমাণে অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করছে।
বার্কলেস ব্যাংকের বিশ্লেষক অমরপ্রীত সিং এক গবেষণায় সতর্ক করেছেন, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে এই সংঘাত অঞ্চলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তেল ও গ্যাস উৎপাদন ও জাহাজ নেটওয়ার্কেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সেই সঙ্গে সবার নজর এখন হরমুজ প্রণালির দিকে। ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের মাঝখানে অবস্থিত এই সংকীর্ণ জলপথ বৈশ্বিক তেল বাণিজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথ। ইরান এর আগে বহুবার এই প্রণালি বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। যদি তা বাস্তবে ঘটে, অনেক তেলবাহী ট্যাংকার আটকে পড়বে এবং তেলের দাম আকাশ স্পর্শ করবে।
আমেরিকার জ্বালানি তথ্য সংস্থা (ইআইএ) জানায়, প্রতিদিন বিশ্বে যে পরিমাণ তেল ব্যবহৃত হয়, তার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ১৮ থেকে ১৯ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি ৯০ লাখ ব্যারেল—এই প্রণালি দিয়ে পরিবহন হয়। তেলের দামের সঙ্গে সবকিছুর দামের সম্পর্ক আছে। ফলে তেলের দাম বাড়লে বিশ্বজুড়ে আবারও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ পরিস্থিতি এমন সময় তৈরি হলো, যখন বিশ্ব বাজার এমনিতেই নানা অনিশ্চয়তায় জর্জরিত। সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে আমদানির ওপর উচ্চহারে শুল্ক বসানোর হুমকি ইতিমধ্যে বিশ্ব বাণিজ্যকে বিপর্যস্ত করেছে। বিনিয়োগকারীরা হারাচ্ছেন আস্থা। এতে ভোক্তা ব্যয় ও ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েল-ইরানের মধ্যকার এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে চাপ আরও বাড়বে। এফএক্স স্ট্রিটের ২০১৯ সালের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে পরের এক বছরে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ইরানঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী, যেমন লেবাননের হিজবুল্লাহ বা ইয়েমেনের হুতিরা এই সংঘাতে যুক্ত হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। এতে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল ও পর্যটন খাত কার্যত অচল হয়ে পড়বে।
২০২৩ সালের শেষ দিকে হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা শুরু করে। তাদের এই হামলার কারণে পণ্য পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যায়; বড় বড় জাহাজ কোম্পানি উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে বিকল্প পথে যাত্রা শুরু করে—এতে সময় ও ব্যয় দুই-ই বেড়ে যায়।
কোপেনহাগেনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান জেনেটারের প্রধান বিশ্লেষক পিটার স্যান্ড বলেন, নতুন করে পথ পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে পরিবহন ব্যয় আরও বাড়বে। তখন জাহাজ কোম্পানিগুলো হয়তো ‘নিরাপত্তা মাশুল’ নামে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করতে পারে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর গ্রিস ও যুক্তরাজ্য বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে হরমুজ প্রণালি পারাপারের প্রতিটি যাত্রা নথিভুক্ত করতে বলেছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের তামার গ্যাসত্রে বা উপসাগরীয় এলাকা থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রফতানি বন্ধ হলে ইউরোপ ও এশিয়ার জ্বালানি বাজারে আরও চাপ তৈরি হবে।
গাজা যুদ্ধের কারণে ইসরায়েলও অর্থনৈতিকভাবে চাপের মুখে আছে। এখন ইরানের সঙ্গে বৃহৎ পরিসরে যুদ্ধ শুরু হলে তার ব্যয় ১২০ বিলিয়ন বা ১২ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে—এমন আশঙ্কা করেছেন ইসরায়েলি অর্থনীতিবিদ ইয়াকভ শেইনিন। এই ব্যয় দেশটির মোট জিডিপির ২০ শতাংশ।
অন্যদিকে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান অনেক আগে থেকেই অর্থনৈতিক সংকটে আছে। তাদের তেল রফতানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে; সেই সঙ্গে মুদ্রার দরপতন অব্যাহত আছে আর মূল্যস্ফীতি প্রায় ৪০ শতাংশ। তেল রফতানি আরও বাধাগ্রস্ত হলে সারা বিশ্বেই তার প্রভাব পড়বে।
২ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের প্রায় সব দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে মন্দার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। এরপর ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করলে বিশ্লেষকেরা মন্দার ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস করেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং সেই সঙ্গে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কনীতি কার্যকর হলে বৈশ্বিক মন্দার ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ●
অকা/বিঅ/ফর/রাত/১৪ জুন, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 5 months আগে

