অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

ঢাকার বাজারে পেঁয়াজের দাম আবারও অগ্নিমূল্যে পৌঁছেছে। মাত্র দুদিনের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বর্তমানে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। তিন দিন আগেও দাম ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। দাম বৃদ্ধির এই ধারা শুধু খুচরা নয়, পাইকারি পর্যায়েও একইভাবে চলছে। রাজধানীর শ্যামবাজার, কারওয়ান বাজার ও কাওরান বাজারে পাইকাররা জানাচ্ছেন, মানভেদে দেশি পেঁয়াজের দাম এখন ৯০ থেকে ১০৫ টাকা কেজিতে উঠেছে, যা গত শুক্র ও শনিবার বিক্রি হয়েছিল ৭২ থেকে ৮৫ টাকায়।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের আড়তদাররা বলছেন, ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কুমিল্লার আড়তদার আবুল কালাম গণমাধ্যমে বলেন, পাবনা ও ফরিদপুরের মোকামে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে সারাদেশের পাইকারি বাজারে। আগের চেয়ে মোকামে প্রতি কেজিতে প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে, বাজারে যে পরিমাণ পেঁয়াজ আসছে, তা চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

চট্টগ্রামের চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারেও একই চিত্র। গত তিন দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। সোমবার, ৩ নভেম্বর, মানভেদে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০৫ টাকায়, যা গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বিক্রি হয়েছিল ৭২ থেকে ৮৫ টাকায়। খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লাহ মিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া গণমাধ্যমে বলেন, ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, মৌসুমি প্রভাব ও আমদানি স্থগিতই এই অস্থিরতার মূল কারণ। দেশে রবি মৌসুমের রোপণ শুরু হয়েছে দেরিতে, ফলে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে সময় লাগবে। পাবনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ীসহ প্রধান উৎপাদন এলাকাগুলোর অনেক জায়গায় এখনো রোপণ শেষ হয়নি। সময়মতো আমদানি অনুমোদন না পেলে দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তবে কৃষি অধিদপ্তর ভিন্ন মত পোষণ করছে। তাদের দাবি, দেশে এখনো পেঁয়াজের কোনো প্রকৃত ঘাটতি তৈরি হয়নি। কৃষকের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ মজুত রয়েছে, তাই এ মুহূর্তে আমদানির প্রয়োজন নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. মো. জামাল উদ্দীন বলেন, “পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এটি নিঃসন্দেহে ব্যবসায়ী কারসাজি। কৃষকের হাতে এখনো প্রায় পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ রয়েছে। আগামী দুই মাস কোনো ঘাটতি হবে না।” তিনি আরও বলেন, “গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ নভেম্বরেই বাজারে আসবে, আর ডিসেম্বরের মধ্যে মুড়িকাটা পেঁয়াজও উঠতে শুরু করবে। ফলে দাম ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

বাজারে হঠাৎ দামের উল্লম্ফন নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা বলছেন। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের বলেন, “বৃহস্পতিবার থেকে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। আমরা এখন ৭৭ থেকে ৮০ টাকায় কিনে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি করছি। গত বছরের এই সময় দাম ছিল ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা। সে তুলনায় এবার দাম তুলনামূলক কম।” কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন মনে করেন, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমদানির অনুমতি আদায়ের চেষ্টা চলছে। তাঁর অভিযোগ, আড়তদার, কমিশন এজেন্ট ও দাদন ব্যবসায়ীদের একাংশ মজুতদারির মাধ্যমে দাম বাড়াচ্ছে।

অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৫ লাখ টন, আর গত মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ টন। তবুও ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে আমদানির অনুমতির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ে জমা পড়েছে দুই হাজার ৮০০টির বেশি আমদানি অনুমতির (আইপি) আবেদন, তবে এখনো কোনো অনুমোদন মেলেনি। অতিরিক্ত উপপরিচালক (আমদানি) বনি আমিন খান বলেন, “আমদানির অনুমতি একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত। বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া আইপি দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সব আবেদন আপাতত ফেরত দেওয়া হয়েছে।”

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুর রহমান বলেন, “গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ নভেম্বরেই বাজারে আসবে। এখন আমদানির অনুমতি দিলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কৃষকের ন্যায্য দাম রক্ষা করাই সরকারের অগ্রাধিকার।” তবে বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, গত মৌসুমে কৃষকরা ন্যায্য দাম না পাওয়ায় অনেকেই আগেভাগে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে এখন মজুতদারদের হাতে থাকা পেঁয়াজ নিয়েই সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে দাম বাড়াচ্ছে।

বর্তমানে দেশে উৎপাদন চাহিদার তুলনায় কিছুটা বেশি হলেও, আমদানি স্থগিত ও মৌসুমি প্রভাবের কারণে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে আরও এক মাস সময় লাগবে। ততদিন পর্যন্ত পেঁয়াজের দামে ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকতে পারে, যদি না সরকার জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়। 
অকা/পবা/ই/সকাল/৫ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 9 hours আগে

Leave A Reply

Exit mobile version