অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার সফর নিয়ে ১১ জুলাই ২৭ দফা যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আর্থিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে লেনদেন নিষ্পত্তিতে স্থানীয় মুদ্রার ব্যবহার বাড়াতে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশ ও চীন।

বেইজিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিনদিনের সরকারি সফর শেষে দেয়া ওই যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও চীন আন্তর্জাতিক ও বহুপক্ষীয় বিষয়ে সমন্বয় জোরদার করতে সম্মত হয়েছে। একই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিন্ন স্বার্থ যৌথভাবে রক্ষায় আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন, মানবাধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি রূপান্তর ও পরিবেশ সুরক্ষা সম্পর্কিত বহুপক্ষীয় বিষয়গুলোয় নিজেদের অবস্থান আরো সমন্বিত ও বৃহত্তর ঐকমত্য গড়ে তুলতে সম্মতি জানিয়েছে।

চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াংয়ের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮-১০ জুলাই বেইজিং সফর করেন। এ সময় তার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াংয়ের বৈঠক হয়। একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে উভয় পক্ষ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং পারস্পরিক স্বার্থে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে গভীর মতবিনিময় করেছেন এবং ব্যাপক ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে চাইনিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওয়াং হুনিংও সাক্ষাৎ করেন।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকীতে চীনা পক্ষকে অভিনন্দন জানানো হয় এবং নতুন যুগে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে দেশটির ঐতিহাসিক অর্জন ও রূপান্তরের প্রশংসা করা হয়। বাংলাদেশ সব দিক থেকে চীনকে একটি মহান আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং এর আধুনিকীকরণের পথে সব ফ্রন্টে চীনা জাতির মহান পুনরুজ্জীবনকে এগিয়ে নিতে তাদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছে। সেই সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে জাতীয় পুনরুজ্জীবনের চীনা স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাদের আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।

এ সময় চীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে এবং নির্ধারিত সময়ে ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণ এবং ‹স্মার্ট বাংলাদেশ› রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে অব্যাহত অগ্রগতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। এছাড়া ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে সমর্থন ও অংশগ্রহণ, দুই দেশের ডিজিটাল ও আইসিটি থিংকট্যাংকগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও ডিজিটাল সক্ষমতা বাড়াতে যৌথভাবে একটি ডিজিটাল ইনোভেশন ল্যাব প্রতিষ্ঠার আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন।

উভয় পক্ষ ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারত্বের প্রশংসা করে এবং চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে সম্মত হয়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পেশ করা বিশ্ব উন্নয়ন উদ্যোগের বিভিন্ন দিক নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে বলেও যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে প্রস্তুত চীন।

২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণের পরও একটি অন্তর্র্বতী সময়ের জন্য চীনের কাছ থেকে করযোগ্য ৯৮ শতাংশ পণ্যের শূন্য শুল্ক (জিরো ট্যারিফ) সুবিধা পাবে। ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে পেয়ে আসা এ সুবিধার জন্য চীনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে বাংলাদেশ। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থায়ন খাতে সহযোগিতা আরো বাড়ানো, বাংলাদেশ-চীন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ।

বাংলাদেশ ও চীন আর্থিক নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়েছে এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে স্থানীয় মুদ্রা নিষ্পত্তির বর্ধিত ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চীনা ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশে শাখা স্থাপনে স্বাগত জানানো হয়।

বাংলাদেশ থেকে চীনে আম রফতানির প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া পাট, চামড়া, জলজ পণ্য ও অন্যান্য উচ্চ মানের বিশেষ পণ্য রফতানি সম্প্রসারণে বাংলাদেশকে স্বাগত জানিয়েছে চীন। এছাড়া উচ্চ মানের বাংলাদেশী কৃষিপণ্য চীনে রফতানির বিষয়ে যোগাযোগ আরো জোরদার করতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। পাশাপাশি বাণিজ্য সহজীকরণ, সহায়তা ও প্রকল্প বা কর্মসূচির জন্য অর্থায়ন বিষয়ে ভবিষ্যৎ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছে বাংলাদেশ ও চীন। দুই দেশই যত দ্রুত সম্ভব বিনিয়োগ চুক্তি আধুনিকায়নের বিষয়ে আলোচনা শুরু করতে সম্মতি দিয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও শিল্প পার্ক, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, নতুন জ্বালানি, পানিসম্পদ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, পোশাক ও অন্যান্য উৎপাদন খাতে চীনা উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো হয়। পাশাপাশি চীনা প্রকল্প ও কর্মীসহ সব বিদেশী বিনিয়োগের নিরাপত্তা, বৈধ অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। উভয় পক্ষ পিপিপি মডেলের মাধ্যমে অবকাঠামো ও নির্মাণ প্রকল্পগুলোয় সহযোগিতা গভীর করার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছে।

ডিজিটাল অর্থনীতি শিল্পে দ্বিপক্ষীয় বিনিময়ে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে চীন। বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে চীনা সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করা হবে। পাশাপাশি ডিজিটাল ও আইসিটি শিল্পের উন্নয়নে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে চীন-বাংলাদেশ উদ্ভাবন সহযোগিতা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখবে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ডিজিটাইজেশনের প্রচারের জন্য ‘তথ্য, শিল্প ও ডিজিটাল বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক বন্দর’-এ সহযোগিতা চালাতে প্রস্তুত আছে বলে জানিয়েছে চীন। এসব উদ্যোগের প্রশংসা ও ধন্যবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের সামুদ্রিক টেকসই উন্নয়ন ও স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সামুদ্রিক পর্যবেক্ষণ, দুর্যোগ প্রতিরোধ ও প্রশমন, ওশান টু ক্লাইমেট সিমলেস ফোরকাস্টিং সিস্টেম (ওএসএফ) ও মেরিন হ্যাজার্ডস আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড মিটিগেশন সিস্টেমের ক্ষেত্রে মেরিটাইম ও ব্লু ইকোনমি সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়েছে দুই দেশই। এছাড়া সামুদ্রিক বিষয়ে আরো এগিয়ে যেতে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে চীন। শিগগিরই দ্বিতীয় দফায় সামুদ্রিক সহযোগিতা সংলাপ আয়োজনে সম্মত হয়েছে দুই দেশ।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে সব পর্যায়ে এবং বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনী ও বিভাগের মধ্যে বিনিময় আরো জোরদার করতে এবং ব্যবহারিক সহযোগিতা বাড়াতে রাজি হয়েছে চীন-বাংলাদেশ। পাশাপাশি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও শান্তি বিনির্মাণের বিষয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্পৃক্ততা ধরে রাখতে একমত হয়েছে দুই দেশ। যৌথ বিবৃতিতে উভয় পক্ষ অভিন্ন মত প্রকাশ করেছে যে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষ, যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হলো দ্রুত প্রত্যাবাসন।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের নেতারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচটি নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে সম্মত হয়েছেন। দুই দেশ দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, দুই দেশের উন্নয়ন কৌশলগুলোর মধ্যে বৃহত্তর সমন্বয় গড়ে তুলতে, বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বে উন্নীত করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। ●

অকা/বাণিজ্য/সকাল/ফর/১২ জুলাই, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 1 year আগে

Leave A Reply

Exit mobile version