প্রণব মজুমদার ●
দেশের ব্যাংকিং খাতের নড়বড়ে অবস্থা আগেও ছিলো। করোনার দুর্যোগে আরও পিছিয়ে পড়েছে এ খাত। ব্যাংকগুলোতে ছাঁটাই চলেছে। বাড়ছে খেলাপী ঋণ। বর্তমানে দেশে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকার ওপরে। গত এক দশকে ব্যাংকিং খাতে চলমান অস্থিরতা ও নৈরাজ্য তথা অনিয়ম-দুর্নীতি, ঋণ জালিয়াতি, খেলাপি ঋণের উচ্চ হার, মূলধনের অপর্যাপ্ততা, উচ্চ সুদের হার, তারল্য সংকট ইত্যাদি বিষয় বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন এবং গণমাধ্যমে বহুলভাবে প্রকাশিত হয়। ব্যাংকিং খাত থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমানতকারী তথা সাধারণ জনগণের অর্থ দীর্ঘদিন ধরেই খেলাপি ঋণের মাধ্যমে আত্মসাৎ হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীতে অর্থনীতির সাংবাদিক হিসেবে গত বছর এপ্রিলের শেষে আর্থিক বাজারে কর্পোরেট সুশাসন শীর্ষক এক কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলাম। এর আয়োজক ছিলেন যৌথভাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও পুঁজি বাজার সাংবাদিক ফোরাম। কর্মশালার শেষে কথা বলেছিলাম। স্বচ্ছ হিসাব ব্যবস্থা নিরূপনে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) নামে যে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হলো, তার স্বচ্ছতা যাচাইয়ের জন্য আগামীতে কোন প্রতিষ্ঠান আসবে? এমন প্রশ্নে হেসেছেন এফআরসি’র চেয়ারম্যান হিসাববিদ সিকিউকে মোশতাক আহমেদ।
আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। অনিয়ম ও দুনীতি এবং সমস্যা নিরসনে জনস্বার্থে সরকারিভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান জন্ম হয়, বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে বড় বড় উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু ক’দিন পরে তা অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মাথাভারি প্রশাসন তৈরি হয়। জনগণের টাকার বিনষ্ট। রাষ্ট্রের অপচয় হয় অর্থ। জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য এবং দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত কতো সরকারি প্রতিষ্ঠান ও দফতর। বাজারে ব্যবসায়িদের দৌরাত¦, শৃংখলা, অনিয়ম এবং কারসাজি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলো। জনগণের পকেট কেটে নেয়া ব্যবসায়িদের সি-িকেট কোন সরকারই ভাঙ্গতে পারেনি! বরং তাদের প্রভাব ও বিস্তার আরও বেড়েছে।
দেশের ব্যাংকগুলোতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে অনেকদিন থেকেই ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার দাবী তোলা হচ্ছে। সকল খাতে পরোক্ষভাবে রাজনীতিকরণের ধারাবাহিকতায় কিভাবে হবে এ কমিশন স্বাধীন?
ড. মোহাম্মদ তারেক অর্থ সচিব থাকাকালে অর্থমন্ত্রীর জন্য প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশনের একটি ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ খসড়া হয়েছিলো। গণচীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের ব্যাংক ও মন্দঋণ সংস্কারের আলোকে একটি খসড়া তৈরি করা হয়। দেশের আর্থিক খাতের সংস্কার দীর্ঘদিন থেকে উপেক্ষিত। আমাদের বর্ধিষ্ণু খেলাপি ঋণ সম্পর্কে অনেক কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু খেলাপি ঋণ কমানো যায়নি। অবশ্য আমাদের এ মানসিকতা এড়ানো উচিত হবে না যে খেলাপি ঋণ কেবল আমাদের দুর্বল সুশাসন কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার ফল। রাজনৈতিক প্রভাব, দায়মুক্তির সংস্কৃতি এবং জবাবদিহি-স্বচ্ছতার ঘাটতি সবই আমাদের ব্যাংকিং খাতে সুশাসনে আঘাত করেছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অধিক সাধারণ ও বৃহৎ পরিসরে কেলেঙ্কারি ও লুটপাট হয়েছে।
রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু দেশে এটি সাধারণ চর্চা। ব্যাংকিং কমিশন যদি স্বাধীন না হয় এবং এসব রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে না পারে, তাহলে অর্থবহ সংস্কারের চেষ্টা বৃথা।
ব্যাংকিং খাতে যেহেতু বেশ কিছু কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে ব্যাংকিং কমিশন একাই সবকিছু সমাধান করতে পারবে না। সুশাসন সমস্যার সমাধানে ব্যক্তি খাতও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গত দশক কিংবা তারও অধিক সময়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগই রাজনৈতিক প্রণোদনা ও সংপৃক্তায় অনুমোদন পেয়েছে বলে সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছেন। তাই এসব ব্যাংক উচ্চ খেলাপি ঋণ ও লোকসানের বোঝায় জর্জরিত হয়েছে তা দৃশ্যমান বাস্তবতা।
অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে স্থিতিশীল ব্যাংক ব্যবস্থা খুবই জরুরি। আর তাই বর্তমান অবস্থা থেকে ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে দরকার একটি স্বাধীন এবং শক্তিশালী ব্যাংক কমিশন গঠন করা। একজন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদের নেতৃত্বে অর্থনীতিবিদ, হিসাববিদ, অভিজ্ঞ ব্যাংকার, ফিন্যান্সিয়াল অর্থনীতিবিদ, আর্থিক বিশ্লেষক, ব্যাংক খাত-সম্পর্কীয় বিশেষজ্ঞ, কোম্পানী বিষয়ক আইনজীবী, নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিনিধি, পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ এবং আর্থিক খাত সম্পর্কিত অন্যান্য বিশেষজ্ঞকে নিয়ে এই কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এখনই সময়। ব্যাংক খাতের পুনর্গঠনে এবং সর্বোপরি জনগণের আস্থা অর্জনেও এই কমিশন গঠন ভালো প্রভাব ফেলবে। কিছু ব্যাংকের একত্রীকরণ হয়তো প্রয়োজন পড়বে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উচিত হবে আর্থিক বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পুরোপুরি বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দেয়া। সরকারি ব্যাংকের ব্যাপারেও একই ভূমিকা থাকা উচিত। ব্যাংকিং খাতের বহুমুখী সমস্যার বাস্তবতায় নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বধিষ্ণু খেলাপী ঋণ ও ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম ও অরাজকতার জন্য পরিস্থিতি উত্তরণে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সম্প্রতি ১০ দফা সুপারিশ করেছে তা সঠিক। সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনায় একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার আহ্বান জানানো হয়েছে যা সময়ের দাবী। সেই পরামর্শগুলোর সঙ্গে আমার মত, দেশের ব্যাংকিং খাতকে পরিবারতন্ত্রের জায়গা থেকে রের করে আনতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে পর্ষদে ব্যাংক, বাণিজ্য এবং অর্থনীতি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়াশোনা করা ব্যক্তি এবং অভিজ্ঞদের নিয়োগ দান করতে হবে। কমিশনকে স্বাধীন করতে চাইলে কোন অবস্থাতেই ব্যাংক পরিচালানার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা কঠিনতম কাজ হবে! তাই দেশে স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা কী এক দুঃস্বপ্ন?
লেখক গল্পকার, কবি, কলাম লেখক এবং অর্থকাগজ সম্পাদক
writerpranabmajumder@gmail.com
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 years আগে