অর্থকাগজ ডেস্ক ●
২৭ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রগামী ভারতীয় পণ্যের ওপর, যেমন হীরা আর চিংড়িতে শুল্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। ওয়াশিংটনের ভাষায়, দিল্লি রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ না করার এটাই হলো শাস্তি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীন সফরে গেছেন, কিন্তু এ সফরের মধ্যেও তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কের চাপ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এই শুল্কে ভারতের রফতানি খাত বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে। সেই সঙ্গে ভারতের উচ্চাভিলাষী প্রবৃদ্ধির ল্যমাত্রাও হুমকির মুখে পড়তে পারে।

এদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংও অর্থনীতিতে গতি আনার চেষ্টা করছেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কের কারণে তার পরিকল্পনাও ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ প্রোপটে বিশ্বের দুই সর্বাধিক জনবহুল দেশের নেতারা সম্পর্কের নতুন দিগন্ত খুঁজতে পারেন, যদিও এ সম্পর্ক এত দিন ছিল অবিশ্বাসে ভরা। এ অবিশ্বাসের মূল কারণ সীমান্ত বিরোধ।

চ্যাথাম হাউসের গবেষক চিয়েতিগ বাজপেই এবং ইউ জি সম্প্রতি লিখেছেন, সহজভাবে বললে, এ সম্পর্কের প্রভাব গোটা বিশ্বে পড়বে। ভারত কোনো দিনই চীনের বিরুদ্ধে সেই প্রতিরোধ দেয়াল হয়ে উঠত না, যেটা পশ্চিমারা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ভাবত। তাই মোদির এ চীন সফরে অনেক কিছুর মোড় ঘুরে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

ভারত আর চীন উভয়ই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর দেশ। তারা যথাক্রমে বিশ্বের পঞ্চম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আইএমএফ এর হিসাবে, ভারতের প্রবৃদ্ধি আগামী কয়েক বছর ৬ শতাংশের ওপরে থাকবে। দেশটির অর্থনীতি ইতিমধ্যে ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের, শেয়ার বাজারের বাজার মূলধন ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে ২০২৮ সালের মধ্যেই ভারত তৃতীয় স্থানে উঠে যাবে।

বেইজিংভিত্তিক উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান উসাওয়া অ্যাডভাইজরির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কিয়ান লিউ বলছেন, বিশ্ব সম্প্রদায় এত দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ককে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপীয় সম্পর্ক হিসেবে দেখেছে। এখন সময় এসেছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি- চীন ও ভারত কীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, সেদিকে নজর দেওয়ার। তবে সম্পর্কটা সহজ নয়। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ এখনো মীমাংসিত হয়নি। সেই বিরোধ মূলত আরও বিস্তৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতীক। ২০২০ সালের জুনে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষ গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রক্তয়ী মুহূর্ত। এর পরিণতিও ছিল প্রধানত অর্থনৈতিক সরাসরি ফাইট আবার চালুর বিষয়টি বাতিল হয়, ভিসা ও চীনা বিনিয়োগ আটকে যায়। ফলে অবকাঠামো প্রকল্পের গতি কমে যায়। ভারত টিকটকসহ দুই শতাধিক চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে।

আন্তর্জাতিক কৌশলবিষয়ক গবেষণা সংস্থা আইআইএসএসের দণি ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক গবেষক অঁতোয়ান লেভেস্কের মতে, সংলাপ জরুরি, কেননা ভারত-চীন সম্পর্ক গোটা এশিয়ার স্থিতিশীলতার েেত্র মূল বিষয়। অন্য শক্তিগুলোও বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেণ করছে। এর বাইরেও নানা স্পর্শকাতর ইস্যু, যেমন তিব্বত, দালাই লামা, যৌথ নদীর ওপর চীনের বিশাল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা পাকিস্তানে পেহেলগাম হামলার পর নতুন করে তৈরি উত্তেজনা।বর্তমানে ভারতের সঙ্গে দণি এশিয়ার বেশির ভাগ প্রতিবেশীর সম্পর্ক ভালো নয়। বিপরীতে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার চীন।

এশিয়া ডিকোডেড নামের গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থনীতিবিদ প্রিয়াঙ্কা কিশোরের ভাষায়, ভারতে কোনো বিওয়াইডি (চীনা গাড়ি নির্মাতা) কারখানা হবে বলে মনে হয় না। তবে ছোটখাটো কিছু সাফল্য আসতে পারে। এরই মধ্যে ঘোষণা হয়েছে, ভারত-চীন সরাসরি বিমান আবার চালু হবে। ভিসা নীতিতে শিথিলতা আনা হতে পারে, অর্থনৈতিক সহযোগিতাও বাড়তে পারে।

তবে দিল্লি-বেইজিং সম্পর্ক মূলত অস্বস্তিকর বলে মন্তব্য করেন কিশোর। মনে রাখতে হবে, একসময় যুক্তরাষ্ট্র আর ভারত জোট বেঁধেছিল চীনের বিপে ভারসাম্য তৈরি করতে। কিন্তু এখন ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বুঝতে পারছে না। তাই এ পদপে চৌকস ও বহুকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণার সঙ্গে মেলে—ভারত ও চীন উভয় দেশই তা সমর্থন করে।

মোদি এবার সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) বৈঠকে যাচ্ছেন। এটি মূলত পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির বিকল্প আঞ্চলিক মঞ্চ। সদস্যদেশগুলোর মধ্যে আছে চীন, ভারত, ইরান, পাকিস্তান ও রাশিয়া। তবে ভারত এত দিন এই সংস্থার গুরুত্ব তেমন একটা ধারণ করেনি। সমালোচকেরা বলেন, এসসিও তেমন উল্লেখযোগ্য ফলও দিতে পারেনি।

চলতি বছরের জুন মাসে এসসিওর প্রতিরামন্ত্রীদের বৈঠক থেকে যৌথ বিবৃতি আসেনি। ভারত আপত্তি তোলে। কারণ, সেখানে কাশ্মীরের পেহেলগামে হিন্দু পর্যটকদের ওপর ২২ এপ্রিলের ভয়াবহ হামলার উল্লেখ ছিল না। যে কারণে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ শুরু হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন ভারত আবার এসসিওর প্রয়োজনীয়তা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। চীনও ট্রাম্পের শুল্ক বিশৃঙ্খলার মধ্যে উন্নয়নশীল বিশ্বের সংহতির চিত্র দেখাতে চাইবে।

অন্যদিকে ব্রিকস জোট- যার সদস্য চীন ও ভারতও ট্রাম্পের রোষের শিকার হয়েছে। তিনি হুমকি দিয়েছেন, নির্ধারিত হারের বাইরেও এই জোটের দেশগুলোর ওপর বাড়তি শুল্ক চাপানো হতে পারে।

সি চিন পিং ও ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মোদির সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে, রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে। গত সপ্তাহে রুশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মস্কোর আশা খুব শিগগির চীন-ভারত-রাশিয়া ত্রিপীয় বৈঠক হবে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তিন দেশের নিজস্ব শক্তি—চীনের উৎপাদন দতা, ভারতের সেবা খাত ও রাশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানো গেলে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নতুন রপ্তানি বাজার তৈরি করা সম্ভব। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতিপথও বদলে যেতে পারে। দিল্লি আবার অন্য আঞ্চলিক মিত্রতাকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। চীন যাওয়ার পথে মোদি জাপান সফর করেছেন। আসিয়ান আর জাপান অবশ্যই চীন-ভারতের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা চাইবে। এতে সরবরাহশৃঙ্খলের বিশেষ সুবিধা হবে, ‘মেক ইন এশিয়া ফর এশিয়া’ ধারণাটিও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, বলেন প্রিয়াঙ্কা কিশোর।

উৎপাদনের জন্য ভারত এখনো চীনের ওপর নির্ভরশীল। কাঁচামাল আর যন্ত্রাংশ সেখান থেকেই আসে। তাই ভারত চাইবে, আমদানি শুল্ক যেন কম হয়।

কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, কঠোর শিল্পনীতি ভারতের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে চীন থেকে সরবরাহশৃঙ্খল সরতে শুরু করলেও ভারত তার সুবিধা পাচ্ছে, দণি-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নয়।

কিশোরের মতে, অংশীদারত্বের বড় সুযোগ আছে, বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস উৎপাদনে। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, অ্যাপল ভিয়েতনামে এয়ারপডসসহ বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করছে, ভারতে তৈরি হচ্ছে আইফোন। ফলে দ্বৈত উৎপাদনের সমস্যা নেই। চীনের জন্য সহজ সাফল্য হতে পারে দ্রুত ভিসা অনুমোদন। চীন চায় ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকার—সরাসরি হোক বা বিনিয়োগের মাধ্যমে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সংকুচিত হচ্ছে, আসিয়ানের বাজার প্রায় ভরে গেছে, অন্যদিকে ভারতে টিকটকের মতো অসংখ্য চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ। ●

অকা/বিবা/ফর/রাত/৩১ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 3 weeks আগে

Leave A Reply

Exit mobile version