অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের রাজস্ব খাত এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সম্মুখীন। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক ধরে দেশের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও আদায়ের একক দায়িত্ব পালনকারী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর বিলুপ্তি ঘোষণা করেছে সরকার। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গত ১২ মে জারি করা এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এনবিআর বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। তবে, সময়ের সাথে সাথে কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ধারাবাহিক ব্যর্থতা এবং কর-জিডিপি অনুপাতের হতাশাজনক চিত্র (বর্তমানে মাত্র ৭.৪ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন স্তরের মধ্যে অন্যতম) প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এই বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে। নীতি প্রণয়ন এবং একইসাথে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানের উপর ন্যস্ত থাকায় কার্যক্ষেত্রে একটি অন্তর্নিহিত সংঘাত তৈরি হচ্ছিল বলে মনে করে সরকার। এই কাঠামোগত দুর্বলতা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা অর্জনের পথে প্রধান বাধা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাও সাক্ষ্য দেয় যে, নীতি নির্ধারণ এবং আদায়কারী সংস্থা পৃথক হলে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই প্রেক্ষাপটেই এনবিআর-এর বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার মূল লক্ষ্য হলো রাজস্ব কাঠামোকে যুগোপযোগী করা এবং কর ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনা।
এনবিআর-এর বিলুপ্তির ফলস্বরূপ দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ আত্মপ্রকাশ করেছে, যা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দুটি প্রধান স্তম্ভকে শক্তিশালী করবে: রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। রাজস্ব নীতি বিভাগ মূলত দেশের কর সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করবে। এর দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বিভিন্ন ধরনের করের (আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), কাস্টমস শুল্ক, সম্পদ কর, সম্পূরক শুল্ক, সারচার্জ) হার নির্ধারণ ও পরিবর্তন, কর অব্যাহতি নীতি প্রণয়ন, স্ট্যাম্প আইনসহ অন্যান্য রাজস্ব সংশ্লিষ্ট আইনের প্রবর্তন ও সংশোধন এবং এই সকল কর ও আইনের নীতিগত নির্দেশনা প্রদান। এছাড়াও, রাজস্ব আইনের ব্যাখ্যা প্রদান এবং প্রয়োজনে সংশোধনের সুপারিশ করার ক্ষমতাও এই বিভাগের উপর ন্যস্ত থাকবে। এই বিভাগের নেতৃত্ব দেবেন অর্থনীতি, রাজস্বনীতি, পরিসংখ্যান, আইন বা প্রশাসনে গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পেশাদার ব্যক্তিরা। সরকারের বিবেচনায় যেকোনো উপযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাকে এই বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণের জন্য অর্থনীতিবিদ, রাজস্ব বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে, যা নিয়মিতভাবে বিভাগটিকে মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করবে।
অপরদিকে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগটি মাঠ পর্যায়ে কর আহরণ এবং তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের উপর বিশেষভাবে মনোযোগ দেবে। এই বিভাগের প্রধান কাজগুলির মধ্যে রয়েছে বর্তমানে প্রচলিত সকল রাজস্ব আইন ও বিধিবিধানের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক কর সংক্রান্ত চুক্তি (যেমন দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি) বাস্তবায়ন করা, করসেবার মানোন্নয়ন এবং কর জালের বিস্তার ঘটানো। এছাড়াও, রাজস্ব ব্যবস্থাপনার জন্য নতুন ও কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবন, রাজস্ব প্রশাসনে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল কাঠামো তৈরি এবং কর ফাঁকি ও অনিয়ম রোধে নিয়মিত নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করাও এই বিভাগের দায়িত্ব। পূর্ববর্তী এনবিআর-এর কর্মরত কর্মীরা প্রাথমিকভাবে এই বিভাগের অধীনে কাজ করবেন, তবে তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু সংখ্যক কর্মীকে রাজস্ব নীতি বিভাগেও পদায়ন করার সুযোগ থাকবে।
রাজস্ব খাতের এই মৌলিক পরিবর্তনকে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। তাদের মতে, নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার পৃথকীকরণ একটি আধুনিক ও কার্যকর রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য শর্ত। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এই ধরনের কাঠামোই প্রচলিত। তিনি মনে করেন, নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব সরিয়ে নিলে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি পাবে। সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত দেশের কর প্রশাসনের দীর্ঘদিনের দুর্বলতা দূর করে আধুনিকীকরণের পথে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। বিশেষ করে, এতদিন যারা করের আওতার বাইরে ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। তবে, এই পরিবর্তনের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলিও আলোচনায় উঠে এসেছে। সাবেক এনবিআর কর্মকর্তাদের একাংশ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, নতুন কাঠামোয় প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্য বৃদ্ধি পেতে পারে, যা রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শুল্ক ও কর ক্যাডারের জ্ঞান ও দক্ষতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এই আশঙ্কা দূর করতে নতুন বিভাগগুলোতে উপযুক্ত পেশাদারদের নিয়োগ এবং তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
সরকারের এই সাহসী পদক্ষেপ বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দীর্ঘদিনের জটিলতা নিরসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দুটি স্বতন্ত্র বিভাগের মাধ্যমে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্যেকার সমন্বয় বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি কর আদায়ের দক্ষতাও বাড়বে বলে আশা করা যায়। তবে, এই নতুন কাঠামো কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হবে এবং এর সুফল সাধারণ মানুষ ও অর্থনীতি কত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে। এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ইতিহাসে একটি মাইলফলক এবং একটি আধুনিক, টেকসই ও জনবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ●
অকা/রা/দুপুর/ ১৪ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 5 months আগে