অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে, যার মূল কারণ হলো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক প্রবাহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যানুসারে, বর্তমানে দেশের গ্রস বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা গত কয়েক মাসের তুলনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এই রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে প্রবাসী আয়, যা ধারাবাহিকভাবে উচ্চমাত্রায় প্রবাহিত হচ্ছে।
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে প্রতি মাসেই দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এর মধ্যে ২০২৫ সালের মার্চ মাসে রেকর্ড ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছে, যা একক মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ। এই ধারাবাহিক প্রবাহ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রিজার্ভ শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করেছে। এর ফলে রিজার্ভে ইতিবাচক প্রবাহ তৈরি হয়েছে এবং ডলার বাজারে কিছুটা ভারসাম্য ফিরেছে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সার্বিক ব্যালান্স অব পেমেন্ট (BoP) বা বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য দাঁড়িয়েছে ৫৩ মিলিয়ন ডলার, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সার্বিকভাবে এখনো ঘাটতি থাকলেও তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ততা এবং আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ঘাটতি কমে আসায় সার্বিক ব্যালান্স অব পেমেন্টের অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। রেমিট্যান্সের শক্তিশালী প্রবাহ চলতি হিসাবকে উদ্বৃত্ত রাখায় মুখ্য ভূমিকা রাখছে। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়লেও তা চলতি হিসাবে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আমদানি ব্যয় বেড়ে বাণিজ্য ঘাটতি ২ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল তুলনামূলকভাবে কম। জুলাই-আগস্ট সময়ে মোট আমদানি ব্যয় ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়ে ১০ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে আমদানি ছিল ৯ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ও বেড়েছে ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ, যা দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলারে; আগের বছরের একই সময়ে রপ্তানি আয় ছিল ৭ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আমদানির চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও, আমদানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। তবে রেমিট্যান্সের শক্তিশালী প্রবাহ চলতি হিসাবকে উদ্বৃত্ত রাখতে সহায়তা করেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সাময়িকভাবে রিজার্ভ বৃদ্ধি পাওয়া একটি ইতিবাচক দিক হলেও, এটি এখনো টেকসই স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয় না। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির পেছনে বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রণোদনা, হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোরতা, এবং ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউসের প্রতিযোগিতামূলক বিনিময় হার ভূমিকা রাখছে। তবে আর্থিক হিসাবে এখনো দুর্বলতা রয়েছে, কারণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ, বিনিয়োগ থেকে মুনাফা স্থানান্তর, এবং মূলধন প্রস্থান বাড়ছে। এসব কারণে সার্বিকভাবে রিজার্ভের ওপর চাপ বজায় থাকছে।
এরপরও ইতিবাচক দিক হলো, রিজার্ভ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। ডলার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে চাপ কমেছে, যা আমদানি ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই অবস্থাকে স্থায়ী করতে হলে রপ্তানি খাতকে বহুমুখী করা, উৎপাদনশীল বিনিয়োগ বাড়ানো এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এখন সবচেয়ে বড় স্বস্তির উৎস। এই আয় কেবল বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে শক্তিশালী করছে না, বরং সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে রেমিট্যান্সনির্ভর স্থিতিশীলতা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, রপ্তানি বৃদ্ধি, এবং আর্থিক হিসাবে ভারসাম্য আনাই হবে টেকসই রিজার্ভ বৃদ্ধির প্রধান উপায়। বর্তমানে যে উন্নতির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তা ইতিবাচক, কিন্তু তা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/১৩ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 19 hours আগে