অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
দেশের ভারী শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ইস্পাত খাতে পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৫৩ শতাংশ। জ্বালানির মূল্য, ডলারের বিনিময় হার ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত এলসি মার্জিন, এলসি কমিশন, লাইবর রেট, সুদহার বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো এতে বড় প্রভাবক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে টান পড়েছে চলতি মূলধনে। অতিরিক্ত এ ব্যয় উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় চাপ সৃষ্টি করেছে বলে জানিয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
কাঁচামাল ক্রয়, দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয়, পণ্য প্রক্রিয়াকরণ, বাজারজাতে ব্যাংক যে মূলধন জোগান দেয় তা-ই চলতি মূলধন। কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চলতি মূলধনের প্রয়োজনীয়তা নির্ভর করে তার পরিচালন চক্রের ওপর।
২০২২ সালের এপ্রিলেও প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা। ধাপে ধাপে তা বেড়ে আনুষ্ঠানিক দর এখন ১১৭ টাকা হয়েছে। এতেই চলতি মূলধনের প্রয়োজন বেড়ে টনপ্রতি খরচ বেড়েছে ১৪ হাজার ৬২৫ টাকা। আগে প্রতি ডলারে ৮৫ টাকা হিসাব করে এর ওপর এলসি কমিশন ও মার্জিন দিতে হতো উদ্যোক্তাদের। অর্থাৎ এলসি কমিশন যেখানে ১৫ পয়সা ছিল এখন তা ৪০ পয়সায় গিয়ে ঠেকেছে। একইভাবে এলসি মার্জিন দিতে হচ্ছে ১৫ শতাংশেরও বেশি, যা আগে ছিল ৫ শতাংশ। এদিকে ব্যাংক সুদহার ৯ শতাংশ থাকলেও এখন ১৪ শতাংশে ঠেকেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কাস্টমস শুল্ক-করাদি। দুই বছর আগেও প্রতি ডলারে ৮৫ টাকা হিসাব করে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, ট্যাক্স, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি, রেগুলেটরি ডিউটি নির্ধারণ হয়েছে। এখন নেয়া হচ্ছে ডলারপ্রতি ১১৭ টাকা হিসাব করে। আবার বিদ্যুতের দাম ৮ টাকা ২৫ পয়সা থেকে বেড়ে এখন ১০ টাকা ছাড়িয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য ছিল ১০ টাকা, তা তিন গুণ বেড়ে ৩০ টাকায় পৌঁছেছে।
বন্দর সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশের ভারী সব শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামে। দেশের ৭০ শতাংশের বেশি রডের চাহিদার জোগান দেয়া হয় এ অঞ্চল থেকেই। তবে উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশই এখন ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিদ্যমান শিল্প-কারখানার উৎপাদন কার্যক্রমে স্থবিরতা অনেক বেশি দৃশ্যমান।
এদিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মানভেদে প্রতি টন রডের দাম এখন ৯২ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তা যেমন স্বস্তিতে নেই, একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে উৎপাদকের ক্ষেত্রেও। কারণ চাহিদা কমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এখানকার শিল্পাঞ্চলের কর্মচাঞ্চল্যে।
উৎপাদন খাতে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই দশকে অর্থনীতির রূপান্তরে মূল ভূমিকায় থাকা উৎপাদনমুখী শিল্পের আকার বড় না হয়ে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছে। অথচ এ পরিস্থিতির জন্য তাদের কোনো দায় নেই, বরং বিশ্বের টালমাটাল পরিস্থিতির পাশাপাশি ভুল পলিসিকেই তারা দায়ী করছেন।
জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডলার যখন হঠাৎ করে ৮৫ থেকে ১০৭ টাকা করা হয়েছিল তখনই উদ্যোক্তাদের প্রায় সবাই ৩০ শতাংশের মতো ক্যাপিটাল লস করেছে। উদাহরণ দিয়ে যদি বলি ১০০ কোটি টাকা লিমিট ছিল ব্যাংকে, সেখানে ৩০ কোটি টাকা লস করে এখন আছে ৭০ কোটি টাকা। রিকয়্যারমেন্ট যেহেতু ৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে, ফলে একই ব্যবসা করতে এখন লাগছে ১৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯০ কোটি টাকার গ্যাপ যেটা সেটা ক্যাপিটাল শর্ট। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। শুল্ক মূল্যায়ন ও সর্বনিম্ন কর বিবেচনায় ব্যবসার খরচ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ এমন সব পরিস্থিতির জন্য আমাদের শিল্পোদ্যোক্তারা এক শতাংশও দায়ী নন। এর জন্য মূলত সরকারের নীতিকাঠামো দায়ী। আমদানিনির্ভর দেশে টাকার ভ্যালু কমানোর ক্ষেত্রে কোনো ধারাবাহিক পদ্ধতিতে না গিয়ে হঠাৎ করে বড় গ্যাপে কমিয়েছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক বিভিন্ন কারণও রয়েছে আজকের এ সংকট তৈরির পেছনে। তাই বলব, বৈশ্বিক কিছু কারণ ও দেশে ভুল পলিসির কারণে ব্যবসা পরিচালনায় এ চাপ অনুভূত হচ্ছে।’
ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, শিল্পের বিকাশ, কর্মসংস্থান ও মোট জাতীয় উৎপাদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে দেখা হয় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিকে। দুই বছর ধরে দেশে চলমান ডলারসহ নানা সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমছেই। বিনিয়োগ যারা করবেন তারা এখন টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলসের (বিএসআরএম) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলীহুসাইন বলেন, ‘আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে আর ভোক্তারও ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। রিজার্ভ পরিস্থিতি যে পর্যায়ে সামনে আসলে কী হতে যাচ্ছে এটা বোঝাও আসলে ডিফিকাল্ট। এই যে ডলার সর্বশেষ ১১৭ টাকা বলা হচ্ছে এটা যে এখানে থাকবে তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। এলসি, ইউটিলিটি কস্ট সবগুলোর প্রভাব এখন ইকোনমিতে দৃশ্যমান হচ্ছে। ফাইন্যান্স রিকয়্যারমেন্ট অনেক বেড়ে গেছে। সরকারিভাবেও নতুন প্রকল্প নেই। ইস্পাত খাতে লিমিটটা এখন বাড়িয়ে দিতে হবে। লং টার্ম লোনে ব্যাংকের আগ্রহ না থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা বিবেচনায় নিতে হবে। মিনিমাম ট্যাক্স নিয়ে যা করা হচ্ছে এটা আরেক ধরনের প্রেসার দিয়ে রেখেছে। লস করলেও দিতে হবে, এটা কোন ধরনের পদ্ধতি, আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। আমাদের পলিসিগুলো এত জটিল যে কখনো সুইটেবল হয় না। কোনো একটা পলিসি সামনে এনে দ্রুত আবার পরিবর্তন করাটা আরো বড় সমস্যা তৈরি করছে। একটা নীতি ঠিক স্থির থাকতে না পারাটা দেশে বিদেশী বিনিয়োগের জন্যও বড় একটা বাধা। এখন উৎপাদন বাড়ানোর জন্য লোকাল ইন্ডাস্ট্রিকে এনকারেজ করতে হবে। এটা ছাড়া ভিন্ন উপায়ও নেই। স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে বিদ্যমান অসংগতি দূর করে কীভাবে সুবিধা দেয়া যায় সেখানেই ফোকাস করতে হবে।’
ইস্পাত খাতের আরেক বড় জায়ান্ট কেএসআরএম। চাহিদা বিবেচনায় এনে চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন ক্ষমতা আট লাখ টনে উন্নীত করে। একই সঙ্গে রডের মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট উৎপাদন কার্যক্রমও সম্প্রসারণ করেছে।
কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, ‘উৎপাদন খরচ বেড়ে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে রড তৈরিতে। গত বছরের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের সেল পড়ে গেছে লক্ষণীয়ভাবে। আগের চেয়ে কম ব্যবসা করতেও আমাদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লাগছে অনেক বেশি। ব্যাংক থেকে সেভাবে সাপোর্ট মিলছে না। অসম্ভব লিকুইডিটি ক্রাইসিসে পড়ে যাচ্ছে সবাই। এটাই উৎপাদন ব্যবস্থার চিত্র। এখন রড ৯২-৯৩ হাজার টাকা চলছে প্রতি টনে, যা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এখন ব্যয় বাড়ার কারণে আরো অ্যাডজাস্টমেন্ট দিতে গেলেও রডের দাম চলে যাবে ১ লাখ টাকার ওপর। ডলার এখনো বড় ইস্যু। লাইবর রেট, এলসি ডিসকাউন্টিং প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচকে বাড়িয়ে তুলেছে।’
আগে আমার সব মিলিয়ে ফরেন এলসিগুলো করতে ৩ শতাংশ লাগত আর এখন ৯ শতাংশ হয়ে গেছে। এদিকে ব্যাংকের এলসি লোকাল যখন ফান্ডেড হয়ে যায় সেটাও চলে গেছে ১৪ শতাংশে। আমরা আশা করেছিলাম নির্বাচনের পর পরই ভোক্তা পর্যায়ে একটা আপসুইং আসবে। কিন্তু এবারো সম্ভবত ব্যতিক্রম হয়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এ সবকিছুর কারণ। এ বছরের মার্কেট আউটলুক খুবই খারাপ। এখন যেসব ইন্ডিকেটর পাচ্ছি, সামনে পজিটিভ কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হলে অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি হবে। ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মূলধন নির্ধারণের সময় টাইড-আপ পিরিয়ড নতুনভাবে নির্ধারণ করতে হবে। উৎপাদন খাতে মূলধন ঘাটতির বিষয়টি নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে হেলাফেলার সুযোগ নেই। কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য আনতে বিনিয়োগ কীভাবে বাড়বে সেই পদক্ষেপগুলো তো নিতে হবে।’
অকা/ইস্পাতশি/ফর/সকাল, ১৯ মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 year আগে