অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কোনো নতুন কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয়নি। এতে শিল্পখাতে পুঁজি বাজার থেকে অর্থায়নের পথ কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে। ভালো কোম্পানির সংকটের কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারের প্রাণশক্তি, অথচ দীর্ঘ সময় ধরে নতুন কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এর আগে অনেক দুর্বল কোম্পানি বাজারে আসায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করা হয়। তখন প্রত্যাশা ছিল, বাজার সংস্কার ও নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবে এক বছরেও কাঠামোগত সংস্কার শেষ হয়নি, আর নতুন কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি।
ফলে শিল্পখাত পুরোপুরি ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। গত এক বছরে শিল্পখাতে ব্যাংক থেকে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা নতুন ঋণ দেওয়া হয়েছে। মার্চ ২০২৪-এ শিল্পখাতে ব্যাংক ঋণ যেখানে ছিল ৬ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি, সেখানে মার্চ ২০২৫-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ, পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ না হওয়ায় ব্যাংক খাতেই চাপ বহুগুণে বেড়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে ৫২টি কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। গড়ে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন এসেছে। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এক টাকাও সংগ্রহ হয়নি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এভাবে নতুন কোম্পানি বাজারে না আসা শেয়ার বাজারের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
বাজারে নতুন আইপিও না আসার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—তালিকাভুক্তির পর কোম্পানিগুলোকে বছরে চার বার আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয় এবং কঠোর জবাবদিহির আওতায় আসতে হয়। অনেক উদ্যোক্তা এটিকে বাড়তি চাপ হিসেবে দেখেন। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হলে কী বাড়তি সুবিধা পাবে—এ প্রশ্নে সন্তোষজনক উত্তর না পাওয়ায় তারা আগ্রহী হচ্ছে না। তাছাড়া বাজার নিম্নমুখী হওয়ায় প্রত্যাশিত মূল্য না পাওয়ার আশঙ্কায় উদ্যোক্তারা আইপিওতে আসতে চান না।
আইপিও নীতিমালা সংস্কারের জন্য টাস্কফোর্স কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—স্টক এক্সচেঞ্জকে প্রাথমিক অনুমোদনের দায়িত্ব দেওয়া, নিরীক্ষকদের মানদণ্ড কঠোর করা, ন্যায্য ভ্যালুয়েশন মডেল তৈরি করা এবং ইস্যু ম্যানেজারদের দায়বদ্ধতা বাড়ানো। এসব বাস্তবায়ন হলে বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরতে পারে এবং নতুন কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হওয়ার পরিবেশ তৈরি হবে। তবে এখনো সংস্কার কার্যক্রম চূড়ান্ত হয়নি।
অতীতে আইপিওতে আসা অনেক দুর্বল কোম্পানি কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়াতেও অনিয়ম হয়েছে। এ ধরনের অভিজ্ঞতার কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়েছেন এবং উদ্যোক্তারাও শেয়ারবাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ ভেবে ব্যাংক ঋণের দিকে ঝুঁকছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, শেয়ার বাজারকে শিল্পখাতের বিকল্প অর্থায়নের উৎস হিসেবে কার্যকর করতে হলে দ্রুত নীতিমালা সংস্কার কার্যকর করতে হবে, সরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার বাজারে ছাড়তে হবে, তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে এবং অনিয়ম কঠোরভাবে দমন করতে হবে। ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরবে, শিল্পখাতে টেকসই অর্থায়নের সুযোগ তৈরি হবে এবং ব্যাংক খাতের ওপর চাপও কমবে। অন্যথায় পুরো অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। ●
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 6 days আগে