অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

মাঠ থেকে সদ্য ওঠা মৌসুমের নতুন পেঁয়াজ ইতোমধ্যে বাজারে আসতে শুরু করেছে। এর পাশাপাশি দেশে এখনো প্রায় এক লাখ টন পুরোনো পেঁয়াজের মজুত রয়েছে। সরবরাহ পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে স্বস্তিদায়ক হলেও বাস্তবে পেঁয়াজের বাজারে নেমে এসেছে চরম অস্থিরতা। আমদানিকারক ও পাইকারি কমিশন বিক্রেতাদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই সুযোগে সরকারকে চাপ দিয়ে আমদানির অনুমতি আদায় করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনুমতি পাওয়ার পরও সেই চক্র পেঁয়াজের বাজারে কার্যত নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে।

আমদানিকারকরা শুরুতে সাধারণ মানুষকে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ সরবরাহের আশ্বাস দিলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে প্রতি কেজি পেঁয়াজ আনতে খরচ পড়ছে প্রায় ৪০ টাকা। পরিবহনসহ সর্বোচ্চ ৫০ টাকা হওয়ার কথা থাকলেও সেই পেঁয়াজ পাইকারি পর্যায়ে ছাড়া হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা দরে। এর ফলে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম গিয়ে ঠেকেছে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকায়। শুক্রবার পেঁয়াজের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অনুসন্ধানে এমন চিত্র সামনে আসে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, কেজিপ্রতি প্রায় ১১০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা আদায় কার্যত ‘সাগরচুরি’র শামিল।

রাজধানীর সর্ববৃহৎ পাইকারি বাজার শ্যামবাজার ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুক্রবার সেখানে আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) বিক্রি হয়েছে ৫৭৫ থেকে ৬০০ টাকায়, অর্থাৎ কেজিপ্রতি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। একই সময়ে পুরোনো দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি পাল্লা ৬৫০ থেকে ৬৭৫ টাকা, যা কেজিতে দাঁড়ায় ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। অন্যদিকে কাওরান বাজার, নয়াবাজার, মালিবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে ঘুরে দেখা গেছে—দেশি ও আমদানি করা উভয় ধরনের পেঁয়াজই বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে। একদিন আগেও দাম প্রায় একই ছিল।

এ অবস্থায় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। তদারকি সংস্থাগুলো চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার পাইকারি বাজারে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ সব খরচ মিলিয়ে কেজিপ্রতি প্রায় ৪০ টাকায় দেশে আসছে। পরিবহন ব্যয় যোগ করলেও এই মূল্য ৫০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অথচ সেই পেঁয়াজ পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। এর পর খুচরা বিক্রেতারা খরচ ও লাভ যোগ করে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়।

শ্যামবাজারের এক পাইকারি ব্যবসায়ী শংকর চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে কথা হলে তিনি আমদানিমূল্য সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি। বরং প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে তিনি বলেন, বাজারে এখন সব ধরনের পেঁয়াজের দামই বাড়তি। তাঁর দাবি, দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কম এবং সরকার আমদানির ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেওয়ায় বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ বাড়ছে না। সে কারণেই দাম কমছে না।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বাজারে পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও পেঁয়াজের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসায়ীরা চাপ সৃষ্টি করে আমদানির অনুমতিও আদায় করেছেন। কৃষকের স্বার্থ উপেক্ষা করে একটি অদৃশ্য শক্তির কাছে নতি স্বীকার করেই সরকার এই অনুমতি দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, আমদানিকারকরা কত দামে পেঁয়াজ এনেছেন এবং কত দামে বিক্রি করছেন—এই তথ্য প্রকাশ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে বাজারে দাম কমবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানায়, পেঁয়াজের বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করতে তালিকাভিত্তিক অভিযান চালানো হচ্ছে। অনিয়ম প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সংস্থাটি আশা করছে, কয়েক দিনের মধ্যেই পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেমে আসবে।

এদিকে বাজারে সরবরাহ বাড়াতে সরকার আমদানি প্রক্রিয়া আরও শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শনিবার থেকে প্রতিদিন ২০০টি করে আইপি (আমদানি অনুমতি) ইস্যু করা হবে। প্রতিটি আইপির বিপরীতে আগের মতোই সর্বোচ্চ ৩০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি থাকবে। কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে যেসব আমদানিকারক অনুমতির জন্য আবেদন করেছিলেন, মূলত তারাই নতুন করে আবেদন করতে পারবেন। তবে একজন আমদানিকারক একবারের বেশি আবেদন করতে পারবেন না।
অকা/প্র/ই/সকাল/১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 6 hours আগে

Leave A Reply

Exit mobile version