অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
চলতি বছর তিন ধাপে দেশের প্রায় অর্ধেক জেলা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হওয়া জেলাগুলো হলো ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারী। এসব জেলা ছাড়াও বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে দেশের বিস্তীর্ণ জনপদের কৃষি, ফল-ফসল ও প্রাণিসম্পদ বিপুল ক্ষতির শিকার হয়েছে। ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএসএমই) খাতও। এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন ব্যাংক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়েছে।
তাদের জন্য পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করে তুলেছে দেশের ব্যাংক খাতে চলমান তারল্য সংকট। প্রায় দুই বছর ধরে চলমান এ সংকট এখন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। কিছু ব্যাংক নতুন ঋণ দেয়া দূরের কথা, গ্রাহকদের জমাকৃত আমানতও চাহিদা অনুযায়ী ফেরত দিতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে অর্থ সংকটে পড়েছে দেশের সিএসএমই খাত। ব্যাংক ঋণ বঞ্চিত হওয়ায় এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে। সচল থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়ন। ১৮ বছর আগে ব্যাংক ঋণ ও ধার নিয়ে পোলট্রি ব্যবসায় নেমেছিলেন এখানকার প্রত্যন্ত এক গ্রামের বাসিন্দা মাসুক। সাম্প্রতিক বন্যা তাকে একপ্রকার পথে বসিয়েছে। লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকার। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ব্যাংক ঋণের সুদহার। পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করতে পারেননি এখনো। ঋণের কিস্তি সঠিক সময়ে পরিশোধ করতে পারছেন না। ব্যবসায় ফেরা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
ফেনীর ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই এখন এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। পোলট্রি ব্যবসায়ী মাসুকের ভাষ্যমতে, ‘করোনার সময় প্রণোদনা ঋণ পেয়েছিলাম। কিন্তু এবার এমন কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমার প্রায় দেড় কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ব্যাংক ঋণ ছিল, ধার-দেনা ছিল। এ পরিস্থিতির কারণে অনেক খামারি এখন ব্যবসা বন্ধ করে চলে যাচ্ছে। নতুন করে ব্যবসা দাঁড় করানোর মতো কোনো পরিস্থিতি ওদের নেই।’
এসএমই খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছর এসএমই খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ কমেছে। ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) এসএমই খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৪ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে এসএমই খাতে ব্যাংকগুলো ৫৪ হাজার ৫২৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। জুন শেষে এসএমই খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ৬ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। তবে এ ঋণের বড় অংশই গেছে মাঝারি আকারের শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয়। ছোট ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের বিনিয়োগ অনেক কম বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এ সংকটের মধ্যেই এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর বেচাবিক্রিতেও দেখা যাচ্ছে মন্দা ভাব। রংপুর ক্রাফটের স্বত্বাধিকারী স্বপ্না রানী সেন বলেন, ‘আমরা মূলত শৌখিন জিনিসপত্র বিক্রি করি। আগে দিনে আমরা ৪০ হাজার টাকার মতোও পণ্য বিক্রি করেছি। এখন তা ২-৩ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। নতুন করে অনেকে ব্যবসা শুরু করার সাহস পাচ্ছে না। সুদহার বাড়ার কারণে অনেক উদ্যোক্তা ঋণও নিচ্ছে না।’
বর্তমানে এসএমই খাত থেকে ব্যাংকের ঋণ আদায়ও ব্যাপক মাত্রায় কমে গেছে। ঋণ আদায় সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে এসএমই খাত থেকে ব্যাংকে ঋণ আদায় কমেছে ৫০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে ছোট ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ আদায় কমেছে ৮৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ আদায়ও ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় এ খাতে ব্যাংকগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের স্থিতি বেড়েছে।
দেশের ক্ষুদ্র, কুটির ও কৃষি খাতের উদ্যোক্তাদের বড় অংশই ব্যাংক ঋণ থেকে বঞ্চিত। এ খাতের উদ্যোক্তারা ঋণের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) বা এনজিওর ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এর মধ্যে এনজিওগুলো সাধারণত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বেশি সুদে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করে। বর্তমানে এ কার্যক্রমেও ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ব্যাংক খাতেই ঋণের সুদহার এখন ১৫-১৬ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মাঝারি ও ছোট ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় তহবিল জোগানে ব্যর্থ হচ্ছে এনজিওগুলোও।
দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিএসএমই খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এসএমই ব্যাংকিং প্রধান সৈয়দ আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের থেকে যারা ঋণ নিয়েছে, তাদের বেশির ভাগই ঋণ সময়মতো পরিশোধ করছে। তবে বন্যার কারণে কিছু এলাকার উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের উদ্যোক্তারা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। আবার গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া, কারফিউ জারিসহ নানা কারণেও উদ্যোক্তারা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’
সৈয়দ আবদুল মোমেন বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যের সংকট থাকলেও আমাদের ব্যাংকে এ সংকট নেই। তবে উদ্যোক্তাদের দিক থেকে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। গত বছর আমরা এমন অনেক গ্রাহক পেয়েছি, যারা নিজেদের ব্যবসা বাড়াতে আগ্রহী ছিলেন। তবে সেই সংখ্যা এ বছর অনেক কমে এসেছে। তাছাড়া সুদের হার এখন প্রায় ১৪ শতাংশ, যার কারণেও অনেক উদ্যোক্তা ঋণ নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা ঠিক কত, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০২০ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উৎপাদন শিল্প জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভারী শিল্পের সংখ্যা ২ হাজার ৮৫৬। আর অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এমএসএমই) কারখানার সংখ্যা প্রায় ৪৩ হাজার। তার মধ্যে অতিক্ষুদ্র ১৬ হাজার ৭৭০টি, ছোট ২৩ হাজার ৩০৬টি ও মাঝারি কারখানা রয়েছে ৩ হাজার ১৭৮টি।
বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রতি বছরই সিএমএসএমই খাতের অবদান বাড়ছে। অর্থনীতিতে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর এ খাতের মূল্য সংযোজন ছিল ৫ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর অর্থনীতিতে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এমএসএমই) মূল্য সংযোজন ২ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা ছিল। পরের বছর সেটি ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এমএসএমই খাতের মূল্য সংযোজন ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ বেড়ে ৩ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২৩ দশমিক ১০ শতাংশ। এর মধ্যে বড় শিল্পের ১১ দশমিক ২০ শতাংশ, এমএসএমইর ৭ দশমিক ৩৫ এবং কুটির শিল্পের হিস্যা ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
যদিও জিডিপি ও কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখা সিএসএমই ও কৃষি খাত এখন নানা সংকটে ধুঁকছে। ফেনীর ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ইকবাল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যার কারণে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো। তবে সরকার থেকে বা কোনো দাতা সংস্থা থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা আমরা পাইনি।’
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ঋণের কিস্তি পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নীতি ছাড় দেয়া হয়েছে। নির্দেশনার আলোকে আমরা গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে ছাড় দিচ্ছি। আবার ব্যাংকের পক্ষ থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার ও তারল্য সংকটের কারণে দুই বছর ধরেই অর্থনীতি চাপে ছিল। এখন পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ চাপ আরো বেড়েছে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও ৪ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখা খুবই কঠিন। তবে পূবালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমরা গ্রাহকদের পাশে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কারণ আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। আমরা এসএমই ও রিটেইল খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে প্রতিটি শাখায় দুজন কর্মকর্তাকে বিশেষভাবে নিয়োজিত করেছি।’ ●
অকা/ক্ষুওমাশি/ই/ সকাল, ২ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 12 months আগে

