অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশে ডিম উৎপাদনে খামারিরা অক্লান্ত পরিশ্রম করলেও দাম নির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। প্রতিদিনের বাজারমূল্য কত হবে, তা তারা জানেন না বিক্রির আগের দিন পর্যন্ত। রাজধানীর তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজারের ডিমের আড়তে আড়তদার, পরিবেশক ও বড় ক্রেতারা মিলে যে দাম নির্ধারণ করেন, সেটিই পরের দিন মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে খামারিদের জানিয়ে দেওয়া হয়। এই তথ্য পৌঁছে দেয় যাদের মাধ্যমে, তাদের বলা হয় ‘মিডিয়া’—যারা আসলে মধ্যস্বত্বভোগী। খামার থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর পুরো প্রক্রিয়ায় পাঁচ থেকে সাতটি ‘মিডিয়া’ বা মধ্যস্বত্বভোগীর হাত ঘুরে ডিম বিক্রি হয়। প্রতিটি ধাপে পরিবহন খরচ, গুদাম ভাড়া ও কমিশনের নাম করে নতুন নতুন মূল্য যোগ হয়। ফলে খামারি পর্যায়ে ডিমের দাম যত কমই থাকুক, ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে গিয়ে সেটি বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
সম্প্রতি মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের ডিম ব্যবসায় এই ‘মিডিয়া’ প্রথা এখন একটি শক্তিশালী বাণিজ্যিক চেইনে পরিণত হয়েছে। কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতাই এই ব্যবস্থার মূল কারণ। খামারিদের সরাসরি পাইকারি বাজারে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই বলে তারা বাধ্য হয়ে এই মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি খামারের মালিকরা পুরোপুরি এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। তারা ‘মিডিয়া’র কাছে ডিম বিক্রি ছাড়া বিকল্প কোনো পথ পান না।
গাজীপুরের আজিরন পোলট্রি ফার্মের মালিক মো. তফাজ্জল হোসেন জানান, খামারিরা যদি সরাসরি ঢাকায় ডিম বিক্রি করতে পারতেন, তাহলে খামারিরা যেমন ন্যায্য মূল্য পেতেন, তেমনি ভোক্তারাও তুলনামূলক কম দামে ডিম কিনতে পারতেন। তিনি বলেন, “আমরা অনেকবার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করেছি—ঢাকায় ১৪-১৫টি পাইকারি বাজার করে দিতে, কিন্তু কেউ উদ্যোগ নেয়নি।” তার মতে, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠলে ডিমের দাম কখনোই অস্থির হবে না।
ডিমের সরবরাহ ব্যবস্থাটি এখন একাধিক স্তরে বিভক্ত। প্রথমে খামারিদের কাছ থেকে স্থানীয় সংগ্রাহকরা ডিম কেনেন। পরে তা উপজেলা পর্যায়ের পাইকারদের কাছে যায়, সেখান থেকে জেলা আড়তে, তারপর ঢাকার পাইকারি বাজারে আসে। ঢাকায় এসে খুচরা বিক্রেতারা তা কিনে নেন এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তার হাতে পৌঁছায়। প্রতিটি ধাপে দাম বাড়ে—একবার পরিবহন খরচ, একবার কমিশন, আবার একবার গুদাম ভাড়া বা প্যাকেজিংয়ের অজুহাতে। ফলে উৎপাদক যেই দাম পান, ভোক্তা তার প্রায় দেড়গুণ পরিশোধ করেন।
খামারিরা অভিযোগ করেন, অনেক সময় ‘মিডিয়া’ ডিমের চাহিদা কম আছে বলে দাম কমিয়ে দেয়। আবার ইচ্ছাকৃতভাবে কয়েক দিন ডিম আটকে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়। এতে লাভ যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে, কিন্তু খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। রাজধানীর খুচরা বাজারে বর্তমানে প্রতি হালি ফার্মের বাদামি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবেও একই দাম দেখা যাচ্ছে। অথচ খামারি পর্যায়ে বাদামি রঙের ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১০ টাকা ১০ পয়সা, অর্থাৎ হালি ৪০ টাকা ৪০ পয়সা। এতে করে এক হালিতে দাম বেড়েছে প্রায় ৯ টাকা ৬০ পয়সা।
মজার ব্যাপার হলো, মাত্র তিন দশক আগেও একজন বাংলাদেশি বছরে গড়ে ১০ থেকে ১৫টি ডিম খেতেন, আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৭টিতে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ডিম এখন দেশের অন্যতম প্রধান প্রোটিন উৎস—যাকে অনেকে বলেন ‘গরিবের প্রোটিন’। তাই এই প্রোটিনের দাম মানুষের আয়-সক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া উদ্বেগজনক।
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী এলাকার রহমান পোলট্রি ফার্মের মালিক মো. আব্দুর রহমান বলেন, “খামারিরা দাম নির্ধারণ করতে পারেন না। তেজগাঁও বা কাপ্তানবাজারে যা নির্ধারণ হয়, আমরা তা-ই পাই। জেলা পর্যায়ে পাইকারি বাজার না থাকায় আমাদের বাধ্য হয়ে স্থানীয় মিডিয়ার কাছে বিক্রি করতে হয়।” তিনি জানান, “আমাদের অনেকের কাছে ৫-১০ হাজার ডিম থাকে, যা ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা সম্ভব নয়। স্থানীয় মিডিয়াই একমাত্র ক্রেতা।”
তিনি আরও বলেন, “খামার পরিচালনার বড় অংশের খরচ খাদ্য ও জ্বালানির পেছনে যায়। ভুট্টা, সয়াবিন মিল, প্রিমিক্স ইত্যাদি বিদেশ থেকে আনতে হয়, ফলে ফিডের দাম বেড়েছে। তার ওপর বিদ্যুৎ ও ডিজেলের খরচ বাড়ায় প্রতি ডিম উৎপাদনের ব্যয়ও অনেক বেড়েছে।” তিনি কর কাঠামোর জটিলতার কথাও উল্লেখ করেন—আয় না থাকলেও খামারিদের বিক্রয়ের ওপর ০.৬ থেকে ১ শতাংশ টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হয়, যা তাদের জন্য মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে।
বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, “ডিমের দাম বাড়ার পেছনে অপ্রয়োজনীয় হাতবদল ও অনিয়মই বড় কারণ। বাজার পর্যবেক্ষণ জোরদার করতে হবে এবং যারা অনৈতিকভাবে দাম বাড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও ক্যাবের সভাপতি এ. এইচ. এম. শফিকুজ্জামান বলেন, “ছোট খামারিরা দুই-তিন হাজার ডিম ঢাকায় পাঠাতে পারেন না, এজন্য তাদের জন্য সমবায় গড়ে তোলা দরকার। দেশে সমবায় বিভাগ থাকলেও তারা বাজারসংযোগে কাজ করছে না। আমি যখন ভোক্তা অধিদপ্তরে ছিলাম, তখন তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজারের সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করেছিলাম। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে ডিমের বাজার অনেকটাই স্থিতিশীল হবে।”
খামারিদের দাবি, ডিম সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় বাজারের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশে ডিম রাখার জন্য কোনো অনুমোদিত কোল্ড স্টোরেজ নেই। ফলে উৎপাদন মৌসুমে দাম কমে গেলে তারা বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করেন। এতে লাভ তো দূরের কথা, অনেক সময় উৎপাদন খরচও উঠে আসে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের মত, ডিমের বাজারকে স্বাভাবিক রাখতে হলে তিনটি উদ্যোগ জরুরি—প্রথমত, বিভাগীয় শহরগুলোতে খামারিদের জন্য সরাসরি বিক্রির পাইকারি বাজার তৈরি করতে হবে; দ্বিতীয়ত, অনুমোদিত কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করে সংরক্ষণের সুযোগ দিতে হবে; তৃতীয়ত, ছোট খামারিদের সমবায় কাঠামোয় যুক্ত করে তাদের বাজারে প্রবেশের সুযোগ বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের ডিম শিল্প এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছে। উৎপাদকরা পরিশ্রম করে দেশের প্রোটিন চাহিদা পূরণ করছেন, কিন্তু ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। অন্যদিকে, ভোক্তারা অযৌক্তিক দামের বোঝা বইছেন। বাজারে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা ফিরিয়ে আনতে না পারলে, এই অস্থিতিশীলতা কেবল খামারিদের নয়—পুরো খাদ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থাকেই ঝুঁকিতে ফেলবে। ●
অকা/প্র/ই/সকাল/২৫ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 18 hours আগে

