অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
দেশে ঋণের বোঝা দিনদিন বাড়ছে। যে শিশুটি আজ জন্ম নেবে, তার মাথায় ৮৪ হাজার ৭৭০ টাকা ঋণের দায় চাপবে। কারণ বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু এই অঙ্কের ঋণ রয়েছে। যা গত এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার ৬৬৩ টাকা। আগামী এক বছরে তা আরও কমপক্ষে ১৩ হাজার ৬০ টাকা বাড়বে। ফলে ওই সময়ে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে প্রায় ৯৮ হাজার টাকা। এ কারণে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটেও ব্যয়ের দিক থেকে চার নম্বরে রয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধের খাত। অন্যদিকে বাজেটে মানুষের মাথাপিছু বরাদ্দ ৩৭ হাজার ৩৩৩ টাকা। এ হিসাবে ঋণ মাথাপিছু বরাদ্দের দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর আদায় করতে না পারায় সরকারকে বেশি ঋণের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ. বি. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকার প্রতি বছর দেশীয় উৎস থেকে যেহারে ঋণ নিচ্ছে, তা অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য ইতিবাচক নয়। কারণ সুদ যে হারে বেড়েছে, তা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। তিনি বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কর আদায়ের হার অত্যন্ত কম। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আদায় ১০ শতাংশের কম। অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে হলে জিডিপির তুলনায় করের অন্তত ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ থাকা উচিত। তিনি বলেন, করের হার বাড়াতে পারলে ঋণ কমবে। আর উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো ভালো পদক্ষেপ নয়। এতে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট নয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ ১১ লাখ ৬০ হাজার ৩৮৩ কোটি এবং সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত মিলিয়ে এই ২ লাখ ১০ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এছাড়া এই পরিমাণ ঋণ জিডিপির ৩৫ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ। এ হিসাবে প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণ ৮৪ হাজার ৭৭০ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৭৫ হাজার ১০৭ টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বেড়েছে ৯ হাজার ৬৬৩ টাকা।
এরপর আগামী অর্থবছরে আরও ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা ঋণ নিতে যাচ্ছে সরকার। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। ফলে ঋণের স্থিতি আরও ১৩ হাজার ৬০ টাকা বাড়বে। এই ঋণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে যে ঋণ নেওয়া হয়, তার বিপরীতে সরকারকে বছরে ১০ শতাংশের বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। এ কারণে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে ৬৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে সরকার। যা দুটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও বেশি। এক্ষেত্রে ঋণ না কমলে এই টাকা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা যেত।
এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ ঋণ অনেক ব্যয়বহুল। সেই ঋণের একটা মোটা অংশ যদি হয় সঞ্চয়পত্র, তাহলে তা আরও ব্যয়বহুল। সরকার ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিচ্ছে, এর অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোয় সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেট মেটাতে অর্থায়নের ৫২ দশমিক ৮ শতাংশই দেশীয় ঋণ। তবে বিদেশি সহায়তা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। তিনি বলেন, ঋণনির্ভরতা কমানোর জন্য রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে রাজস্ব খাতে বিভিন্ন সংস্কার জরুরি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, সরকার ঠিকমতো ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না বলেই এর দায় নিতে হচ্ছে জনগণকে। তুলনামূলকভাবে বিদেশি ঋণ অনেক সাশ্রয়ী। কিন্তু সরকার সহজ পথ হিসাবে বেছে নেয় বেশি সুদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে। এতে আর্থিক খাতে চাপ বেড়ে যায়।
বর্তমানে দেশে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের (ব্রডমানি) পরিমাণ ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে আমানত ১২ লাখ ৯৯ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা এবং জনগণের হাতে নগদ টাকা ১ লাখ ৮৪ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। আবার আমানতের মধ্যে মেয়াদি আমানত ১১ লাখ ৫৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা এবং তলবি আমানত ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা।
অ র্থ ম ন্ত্র ণা ল য়ে র প্র তি বে দ ন
ছয় মাসে সরকারের ঋণ ৬৪ হাজার কোটি টাকা।
কোভিড-১৯ মহামারিসহ সার্বিক ব্যয় মেটাতে ২০২০-২১ অর্থ বছরে ছয় মাসে প্রায় ৬৪ হাজার (৬৩ হাজার ৮২৫) কোটি টাকা দেনা করেছে সরকার।
এর মধ্যে বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণের হার হচ্ছে ৩০ শতাংশ। বাকি ৭০ শতাংশ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ খাত (ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র, ট্রেজারি বিল) থেকে নেওয়া হয়েছে। ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ খাত থেকে গত বছরের তুলনায় ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে।
তবে কমেছে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে ঋণ নেওয়া হার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণ বুলেটিন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
ঋণ নেওয়ার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, অভ্যন্তরীণ এবং সার্বিক ঋণ গ্রহণমাত্রার হার অর্থনীতিতে এখনো কম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। পাশাপাশি ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধকারী হিসাবে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থানে আছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ. বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিদেশি ঋণ গত বছরের তুলনায় কম নেওয়ার কারণ হচ্ছে ঋণের অর্থ ব্যবহার করতে পারছি না। অর্থাৎ কাজ হচ্ছে না। যা অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয়।
তিনি আরও বলেন, দেশের রাজস্ব আদায়ের গতি ভালো নয়। অন্যদিকে করোনার কারণে নানা ধরনের প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও চলছে। যে কারণে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। তবে সার্বিক ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে আশঙ্কার কিছু নেই। বাজেট ঘাটতি ৬ শতাংশের বেশি হলেও সমস্যা হবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় গত দুই বছর সরকারের ব্যয় বেড়েছে। কারণ করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যেখানে আর্থিক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য সম্প্রতি অর্থ বিভাগ থেকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় না করার জন্য একটি নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থ বছরে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা।
এই ঋণ নেওয়া ঠিক করা হয় বাজেট ঘাটতির হিসাব করে। যে পরিমাণ বাজেট ঘাটতি থাকে সেটি পূরণ করতে ঋণ নেওয়া হয়। ঋণ মূলত দুটি উৎস থেকে গ্রহণ করা হয়। একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ খাত- ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ। তবে দুটি খাত থেকে অর্থ বছরের ছয় মাসে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৬৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। এটি লক্ষ্যমাত্রার ৩৮ শতাংশ।
সূত্র মতে, ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৮২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণ নেওয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৮৮০ টাকা। এটি লক্ষ্যমাত্রার ৩০ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ নেওয়া হয়েছে ২০ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। তবে সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর হিসাবে গত মার্চ পর্যন্ত অর্থাৎ ৯ মাসে (জুলাই থেকে মার্চ) ৮৫ হাজার ৯৯০ কোটি ৬৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এটি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২০০ শতাংশের বেশি। জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদের হার ৫ শতাংশ বা এর নিচে অবস্থান করছে। তবে সে তুলনায় সঞ্চয়পত্র সুদের হার ডাবল ডিজিট রয়েছে। ফলে আমানতকারীরা এখন সঞ্চয়পত্রকে একমাত্র বিনিয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র মনে করছে। এজন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে গেছে।
ঋণ নেওয়া পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ৬ মাসে ৫ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ১২ শতাংশ, পারিবারিক সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া হয় ৩৫ শতাংশ, তিন মাস মেয়াদি সঞ্চয়পত্র থেকে ২৩ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্র থেকে ৮ শতাংশ, ওয়েজ আর্নার সঞ্চয়পত্র থেকে ৪ শতাংশ এবং অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে এক শতাংশ ঋণ। এ সময় অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হয়েছে ৩৯৭ কোটি টাকা।
করোনার কারণে সরকারের সার্বিক ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ পেতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোর কাছে চিঠি দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে। এরই মধ্যে বেশ কিছু সাড়াও পাওয়া গেছে।
চলতি অর্থবছরে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭২ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। এর থেকে অর্থ বছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিদেশি ঋণ পাওয়া গেছে ১৮ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এটি লক্ষ্যমাত্রার ২৬ শতাংশ এবং মোট ঋণের ৩০ শতাংশ। তবে গত বছরের তুলনায় বিদেশি ঋণ পাওয়া হার কমেছে। ঋণ বুলেটিন সূত্র মতে, সবচেয়ে বেশি সহায়তা করছে বিশ্ব ব্যাংক। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে গত ছয় মাসে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রার ৩৮ শতাংশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক এ সংস্থা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। এ সংস্থা ঋণ দিয়েছে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া জাপান একটি বড় সহায়তার অবস্থানে আছে বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে। সেখান থেকে ঋণ পাওয়া গেছে লক্ষ্যমাত্রার ১৭ শতাংশ। রাশিয়া থেকে ঋণ পাওয়া গেছে ৬ শতাংশ এবং চীন দিয়েছে ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পাশাপাশি চায়না (বিসি) থেকে পাওয়া গেছে ৩ শতাংশ এবং ভারত দিয়েছে ১ শতাংশ।
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 years আগে