অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে দেশের পুঁজি বাজার বরাবরই মন্দার মধ্য দিয়ে পার করেছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ঘটার পর ৬ আগস্ট ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচকটি অবস্থান করছিল ৫ হাজার ৪২৬ দশমিক ৪২ পয়েন্টে। একই দিন ডিএসইর অপর দুই সূচক ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহর অবস্থান রেকর্ড করা হয় যথাক্রমে ১৯৩৪ দশমিক ৭৪ ও ১১৭৬ দশমিক ৬১ পয়েন্টে। ওই দিন বাজারটির মূলধন ছিল ছয় লাখ ৬৩ হাজার ৩৪৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। একই দিন বাজারটি ৭৪৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকার লেনদেন নিষ্পত্তি করে।
৮ মে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ছয় লাখ ৫২ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। ওই দিন ডিএসইর প্রধান সূচকটি অবস্থান করছিল ৪ হাজার ৯০২ পয়েন্টে। ডিএসইর অপর দুই সূচক ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহর অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১৮০২ ও ১০৭৪ পয়েন্টে। এ দিন বাজারটি লেনদেন নিষ্পত্তি করে ৩৬৬ কোটি টাকার। সে হিসাবে ৯ মাসে পুঁজি বাজার অনেকটা একই জায়গায়ই ঘোরাঘুরি করছে। শুধু ব্যতিক্রম ছিল পটপরিবর্তনের পর একটি সপ্তাহ।
নতুন সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সাময়িক উচ্ছ্বাস দেখা যায়। এর প্রকাশ ঘটে পরবর্তী কয়েক দিনের লেনদেনে। ৬ আগস্ট ৭৫০ কোটি টাকা লেনদেন হওয়া বাজারটির লেনদেন ১১ আগস্ট পৌঁছে যায় দুই হাজার ১০ কোটি টাকায়। ৬ আগস্ট ৫ হাজার ৪২৬ পয়েন্টে থাকা সূচকটি ১১ আগস্ট পৌঁছে যায় ৬ হাজার ১৫ দশমিক ৯০ পয়েন্টে। এখানেই শেষ। এরপর গতি হারাতে থাকে পুঁজি বাজার। নতুন সরকারের দায়িত্ব নেয়ার সাথে সাথে দেশের আর্থিক খাতের ব্যাপক অনিয়ম প্রকাশিত হতে শুরু করলে পুঁজি বাজারে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে ব্যংকিং খাতের ব্যাপক লুটপাটের খবরে পুঁজি বাজারের বিনিয়োগকারীদের উচ্ছ্বাস ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। পূর্ববর্তী সরকারের ঘনিষ্ঠজনদের দ্বারা একের পর এক দেশ থেকে সম্পদ পাচারের খবর প্রকাশ হতে থাকলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকে। পুরো ব্যাংকব্যবস্থা অনেকটা সঙ্কটের মধ্যে নিপতিত হতে থাকে। সাধারণ মানুষ তাদের আমানত ফেরত পাওয়া নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। এর প্রভাবে পুঁজিবাজারে আরো বেশি আস্থাহীনতা ভর করে।
পরবর্তীতে ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করা হলে নতুন কমিশন বাজারের আস্থাহীনতা কাটিয়ে ওঠার মতো উপাদান যোগ করতে পারেনি। কারণ যেখানে গোটা অর্থব্যবস্থাই নাজুক পরিস্থিতি পার করছে সেখানে কোন জাদুবলে শেয়ার বাজার ভালো করা যায় তা নতুন কমিশনের জানার কথাও নয়। ফলে তলানিতে থাকা বিনিয়োগকারীদের এ আস্থা ফেরা দূরের কথা ক্রমেই তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ সময় নেগেটিভ ইক্যুইটি নিয়ে বিভিন্ন ব্রেকার হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর ফোর্স সেল পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তোলে। এতে মূলধন হারিয়ে সর্বশ্বান্ত হয়ে যান বিনিয়োগকারীরা।
৯ মাসের পুঁজি বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় গত আগস্টের পর পুঁজি বাজার ক্রমেই নিম্নমুখী হয়েছে। ওই বছর ২৮ অক্টোবর ডিএসই প্রধান সূচকের অবস্থান ছিল ৪ হাজার ৮৮৯ পয়েন্টে। অথচ এর দুই মাস আগে ১১ আগস্ট সূচকটি অবস্থান করছিল ৬ হাজার ১৫ পয়েন্টে। সে সময় মাত্র অল্প কিছু দিনের মধ্যে সূচকের ১১০০ পয়েন্ট অবনতি ঘটতে দেখা যায়। এর পরের কয়েক দিনের মধ্যেই হারানো সূচকের একটি বড় অংশ ফিরে পায় পুঁজি বাজার। ৫ নভেম্বর ডিএসই সূচক পৌঁছে যায় ৫ হাজার ৩৬৫ পয়েন্টে। এরপর বাজার সূচকের আর খুব বেশি ওঠানামা করতে দেখা যায়নি। ২০২৫ সালের শুরু থেকে সর্বশেষ ট্রেডিং দিন পর্যন্ত সূচকের ওঠানামা ৩০০ পয়েন্টে মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কখনো কখনো তা ৫ হাজার পয়েন্টের কিছু বেশি আবার কখনো তা ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে আসছিল। কিন্তু এর মূল কারণ ছিল সার্বিক আর্থিক খাতে অস্থিরতা এবং পাশাপাশি বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা।
এক দিকে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণে বাজারে নতুন বিনিয়োগ প্রবেশ করছিল না, অন্য দিকে সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলো আমানত আকর্ষণে সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। সরকারি ট্রেজারি বন্ডেও এ হার বৃদ্ধি করে। ফলে বাজারের তারল্যের একটি অংশ এসব দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। এ দিকে তারল্যের অভাবে মূলধন হারাতে থাকে পুঁজি বাজার। মাঝখানে সব দোষ গিয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঘাড়ে। অথচ বিগত ২০১০ সালের পুঁজি বাজার বিপর্যয়সহ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে তৎকালীন সরকার ও এর ঘনিষ্ঠজনরা ডিরেক্ট লিস্টিং, প্রেফারেন্স শেয়ার ইস্যু ও তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানিকে অন্য কোম্পানির সাথে মার্জার এবং বন্ড ইস্যুর নামে ভাঁওতা দিয়ে বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছে তা নিয়ে কোনো মিছিল মিটিং বা চোখে পড়ার মতো প্রতিবাদ হয়নি।
দেশের পুঁজি বাজারের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা কোনো সময়ই পুঁজি বাজারকে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের মূলধন উত্তোলনের মাধ্যম হিসেবে নিতে পারেনি। কারণ এখানে ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা যত সহজ পুঁজি বাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। তা ছাড়া ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে যে দেশে পার পাওয়া যায় সে দেশে সাধারণ পাবলিক থেকে মূলধন নিয়ে তাদের কাছে জবাবদিহি কেইবা করতে চায়।
সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, যত দিন দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা না ফিরবে আর উদ্যোক্তারা পুঁজি বাজারকে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনের উৎস হিসেবে গ্রহণ না করবে তত দিন পুঁজি বাজারের সত্যিকার অগ্রগতি সম্ভব নয়। তা ছাড়া বিগত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে যে অনিয়মের মধ্য দিয়ে দেশের পুঁজি বাজার অতিক্রম করেছে তাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চাই সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা। পাশাপাশি এত দিন যেসব অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করা, যাতে পুঁজি বাজারের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা বাজারের ওপর আবার আস্থা ফিরে পায়। ●
অকা/পুঁবা/ফর/রাত /১১ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 month আগে